- শেষ পর্যন্ত তুমিও একটা করতে পারলে ?
এটা সেই জুলিয়াস সিজারের অমর বাক্যের মতো - "ব্রুটাস, শেষ পর্যন্ত তুমিও?"
এটাই মনে হয় মানুষের স্বভাব, বিশেষ করে অভাবী মানুষের। এই লোকগুলো কোনো দিনই খারাপ ছিল না, কাজ করে জীবন যাপন করতো। সৎ, বিশ্বস্ত। কিন্তু হঠাৎ যখন সুযোগ এলো, কেউই ভাবলো না, এটাতো প্রতিবেশীর বাড়ী, এটাতো প্রতিবেশীর জিনিষ - সেই প্রতিবেশী যার সাথে প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো, সুখ-দুঃখের গল্প হতো। কোথায় এদের জিনিষপত্র পাহারা দেবে, তা না করে সব লুট করে নিয়ে নিলো। হঠাৎ করেই সব নৈতিকতা, সব নিয়ম-কানুন জীবন থেকে মুছে গেলো। বাঙ্গালীর উপর পাক হানাদারদের চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধ একদিকে যেমন দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উজ্জীবিত করলো লাখ লাখ তরুণকে, একই ভাবে জন্ম দিলো দেশদ্রোহী রাজাকারদের। আর এই দুই মেরুর মধ্যে রয়ে গেল এক বিশাল জনতা, যারা এই সুযোগে সাধারণ নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে লুট করলো প্রতিবেশীদের ধনসম্পদ। কে জানে, আজ যে দেশে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের হিড়িক পরে গেছে তার বীজটা ওই একাত্তরেই রোপিত হয়েছিল কিনা?
একাত্তরের ওই দিনগুলোতে বাঙ্গালী হিন্দুকে অনেকগুলো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধের আগে চাপ আসতো মূলতঃ সরকারের পক্ষ থেকে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সাধারণ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন গণ আন্দোলনের সময় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সব বাঙ্গালীই ছিল যাত্রী একই তরণীর। আমি নিজে দাঙ্গা দেখিনি, তবে ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান দেখেছি। দেখেছি তখন কিভাবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। একাত্তরে পালানোর আগেও সবাই মিলে ঢাকা থেকে বানের জলের মতো ভেসে আসা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যখনই পাক সরকার অন্ততঃ গ্রামাঞ্চলে এই যুদ্ধকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী রূপ দিতে সক্ষম হলো, তখন হিন্দুরা যেন অভিমূন্যের মতো চক্রব্যূহে আটকা পরে গেলো। আজ তার শত্রু শুধু হানাদার পাক বাহিনী নয়, তার পাশের বাড়ীর লোকটাও। এরা পরের মাঝে পরতো সারা জীবনই ছিল, এখন তারা আপনের মাঝেও পর হয়ে গেলো। দেশে আজ পরেরা চলে গেছে, কিন্তু আপনেরা এখনো এদের আপন করে নিতে পারে নি, তাইতো এখনো তারা আপনের মাঝেও পর হয়ে রয়ে গেছে।
যুদ্ধ পরবর্তী গ্রামের কথায় আমরা পরে আসবো, তবে আগ বাড়িয়ে শুধু এটুকুই বলতে পারি, প্রথমে একটু দ্বিধা দেখা দিলেও সবার সাথে আবার আগের মতোই সম্পর্ক গড়ে উঠে। শুধুমাত্র জ্যাঠামশায় আর তার ঘনিষ্ট বন্ধু জলিল চাচা (জলিল মেম্বার) আর কখনো কথা বলেনি। এখন মনে হয় অযথাই তারা নিজেদের মতভেদগুলি দূর করেনি। তবে তখন খুব ছোট ছিলাম, অনেক কিছুই আজকের মতো করে বুঝতাম না। জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অনেক কিছু নতুন করে বুঝতে শিখেছি, নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি। না না, এটা কোনো মনস্তাত্বিক ব্যাপার নয়, তবুও মনে হয় আমি নিজের অজান্তেই সে কাজটা করি।
ছবি তুলি বলে অনেকেই আমার কাছে আসে। দেখি ওরা যতটা না ছবি তুলতে আসে, তার চেয়ে বেশী কথা বলতে। মনে হয়, যেহেতু আমি বিদেশী আর লোকজনের সাথে কম মিশি আমি কথা ফাঁস করবো এ ভয় না পেয়ে আমাকে ওদের কথা বলে যায়। অনেকটা সমাধি ক্ষেত্রে কথা বলার মতো। এদেশে মানুষ নিজেদের মনের কথা বলার জন্য প্রিয়জনদের সমাধিতে যায়, কেননা সমাধি গোপনীয়তা রাখতে পারে। আমিও অনেকটা তাই। আর ভালো পোর্ট্রেটের জন্য দরকার রিল্যাক্স মুড্। আমি নিজেই ওদের উৎসাহিত করি এজন্যে। আর মানুষ রিল্যাক্স ফিল করে যদি যার সাথে বসে আছে তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে। অনেকেই বলে তাদের সমস্যার কথা, তাদের ভালোলাগা বা মন্দলাগার মানুষদের কথা। অনেকটা টু ইন ওয়ান - ছবি তুলাও হলো আবার নিজের কথাগুলো বলে মনকে হালকা করাও গেলো। আমি প্রায়ই ওদের একটা গল্প শোনাই, যেটা নিজে সব সময় মেনে চলি। এ গল্পটা আমাকে বলেছিলো আমার ক্লাসমেট কাম রুমের শ্রীকুমার। প্রচন্ড ভালো মানুষ ছিল ও, আর তাই হয়তো নিজের পড়াশুনাটা ঠিক মতো শেষ করতে পারেনি। যদিও এক রুমে থাকতাম ওর সাথে আমার কথা হতো কালে ভদ্রে। সকালে আমি আর ইয়েভগেনি যখন ক্লাসে চলে যেতাম ও ঘুমুতো, আর রাতে ও যখন ফিরত আমরা ঘুমোতাম। তারপরেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে গেলে গল্প করতাম, বেড়াতে যেতাম। প্রায়ই যেতাম রাতের আরবাতে, যেখানে হিপ্পিরা গিটার বাজিয়ে গান করতো আর পুলিশ এসে আমাদের চলে যেতে বলতো। দূরে গিয়ে দাঁড়াতাম, কিন্তু পুলিশ পিছু ছাড়তো না। কখনো কখনো যেতাম চার্চে, বৃদ্ধা মহিলারা আমাদের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতো। কুমার চেষ্টা করতো ক্রস আঁকতে , আমি সেটাও করতাম না। এই কুমার একদিন আমাকে একটি গল্প বলে। ও বলেছিলো সার্ত্রে র কোনো এক লেখায় পড়েছিল, কিন্তু আমি সার্ত্রে র প্রায় সব লেখা পরেও এটা উদ্ধার করতে পারিনি।
অনেক দিন আগে প্যারিসে জন আর পল নাম দুই বন্ধু বাস করতো। জন খুব নামকরা শিল্পী আর পল বিশ্ববিখ্যাত লেখক। উভয়েই অনেক আগেই জীবনের মধ্যাহ্ন পেরিয়ে বার্দ্ধক্য ছুঁই ছুঁই করছে। বিকেলে যেহেতু করার কিছুই থাকে না, দুজনেই এসে বসে এক বিখ্যাত ক্যাফেতে - গল্পে গল্পে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে প্যারিসের আকাশে। এভাবেই সুখ-দুঃখে কাটে তাদের দিন। একদিন জনের অন্য এক বিশ্বস্ত বন্ধু জনকে বলে
- তুমি কি জানো যে পল হোমোসেক্সুয়ালিস্ট?
- হতেই পারে না।
অনেকটা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে জন। তারপর ভাবতে থাকে, আচ্ছা এই বন্ধুর তো পলের নামে মিছিমিছি মিথ্যে বলার কথা ছিল না। ব্যাপারটা কি? তাই সে এক গোয়েন্দার শরণ নেয়। কয়েকদিন পরে গোয়েন্দা প্রমান নিয়ে আসে যে পল সত্যি সত্যি হোমোসেক্সুয়ালিস্ট। খুব আপসেট হয় জন। বিকেলে পলকে সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, পল শুধু মাথা নাড়িয়ে বলে
- তুমি যা জেনেছো ভুল জেনেছো।
এর পর থেকে তাদের বন্ধুত্বের ইতি ঘটে। কেউই আর এই ক্যাফেতে আসে না, দেখা করে না, খোঁজ খবর নেয় না। এভাবেই কাটে মাসের পর মাস। হঠাৎ একদিন প্যারিসের এক রাস্তায় দেখা হয় দুজনের। পল জনের কাছে এসে বলে
- দুটো কথা বলি, শোন। এই দেখো, আমি নামকরা লেখক। আমার বৌ আছে, ছেলেমেয়ে আছে। প্রতিদিন আমি ঘুম থেকে উঠে স্নান করি. চা খাই, বাজারে যাই, বাচ্চাদের সময় দেই, গল্প লিখি। সারা দিন এভাবে আমি হাজারো কাজ করি। এই হাজার কাজের একটা আমার হোমোসেক্সুয়ালিটি। এটা তো মানুষ খুন করা নয়, সমাজের ক্ষতি করা নয়। তাহলে বলতো তোমার কাছে আমার সব পরিচয় ছাপিয়ে এটাই বড় হলো কেন? আমার শত শত পরিচয়ের একটা এটা, আর তোমার কাছে এটাই আমার একমাত্র পরিচয় - এখানটাতেই আমার আপত্তি।
এই গল্পটা একেক জন একেক নিতে পারে, তবে আমার জন্য মনে হয় প্রতিটি মানুষকেই, প্রতিটি ঘটনাকেই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হয়, বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখতে হয়। তা না হলে অনেকটা অন্ধদের হাতি দর্শনের মতো হয়ে যাবে - কেউ লেজ ধরবে, কেউ কান, কেউবা শুঁড় আবার কেউবা পা - এভাবেই একটা আংশিক ধারণা নিয়ে পুরা ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করবে।
তবে স্বাভাবিক অবস্থায় এসব মনে রাখলেও জরুরী অবস্থায় আমরা এসব ভুলে যাই। যার ফলে সারা জীবন হাতে হাত রেখে চলার পরও আমরা কালকের বন্ধুরাই আজ ধর্ম, বর্ণ বা রাজনীতির নামে একে অন্যকে খুন করতে পর্যন্ত পিছপা হই না। উল্টোটাও ঘটে। গল্পটা আমার দিদির মুখে শোনা। ২০০১ এ যখন দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তুঙ্গে, মৌলবাদীরা যখন মিছিল করে আমাদের গ্রামের দিকে আসছিলো হিন্দুদের আক্রমণ করতে, ওই মিছিল থেকেই এক ছেলে দৌড়ে আসে আমাদের বাড়ী। ও ছিল সুধীরদার ছাত্র, এসেছে স্যারকে সাবধান করে দিতে। আর পাশের বাড়ীর মজনু ভাই এসে নিয়ে গেছে সবাইকে নিজের বাড়ীতে। ভালো মন্দ এসব নিয়েই জীবন।
এক সময়ে রাশিয়াতেও বিদেশীদের উপর আক্রমণ হতো। আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুরা তাই আমাকে একা যেতে দিতো না কোথাও, ওদের সাথেই গিয়ে ছবি তুলতাম। কয়েকদিন আগে নদীর ওপরে ক্লাবে গেছি। সাধারণত বন্ধুদের কেউ নিয়ে যায় আবার গাড়িতে করে বাড়ী পৌঁছে দেয়। ওই দিন একাই গেছি। অনেক দিন এসব ঘটে না, তাই কোন চিন্তা ছিল না। রাত ১১ টার দিকে যখন বেরুবো, স্লাভা বললো, চল তোকে এগিয়ে দেই। যদিও কথা ছিল ও আরো কাজ করবে। কথা বলতে বলতে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। বাস আসে না। কথাও ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, ও একথা ওকথা বলে সময় নষ্ট করছে। বাস এলে আমি উঠে বসলাম, ও চলে গেলো। পরে আমি বুঝলাম, আসলে আমি যাতে ঝামেলায় না পড়ি তাই ও ইচ্ছে করেই কথা বলে বলে আমার সাথে ছিল। আসলে প্রতিদিন কত লোক যে আমাদের "হাই" বলে, হেসে স্বাগত জানায় - কয়টা মুখ আমরা মনে রাখি? অথচ কেউ একটু গালমন্দ করলে দিনের পর দিন ওই মুখটা ভাসে চোখের সামনে।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম। একটা সাদা কাগজে এক ফোঁটা কালো দাগ। শিক্ষক প্রশ্ন করেছে, কি দেখছে ছাত্ররা। সবাই ওই কোলো দাগ নিয়েই লিখছে। যেন সাদার কোনো অস্তিত্বই নেই। শিক্ষক পরে বলছে, আমরাও জীবনে কালো অংশ গুলোই দেখি, কষ্ট গুলোই মনে রাখি। আমার মনে হয় এটা সন্দেহজনক সিদ্ধান্ত। আমি নিশ্চিত যদি কালো ক্যানভাসে একফোঁটা সাদা দাগ থাকতো, ছাত্ররা ওই সাদা দাগ নিয়েই লিখতো। মানুষ বা চোখ সব সময় কন্ট্রাস্ট খুঁজে। প্রশান্ত পুকুরের জলে এক টুকরো পাথর ছুঁড়ে দিলে যে ঢেউ তৈরী হয় ওটাই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকি পুকুরটা আমাদের নজরে আসে না। একই ভাবে চারিদিকে যখন অনেক ভালোর মধ্যে হঠাৎ মন্দ কিছু দেখি তা আমাদের চোখে পরে বেশী, যেমনটা চোখে পরে ছোট্ট একটা ভালো কাজ অনেক মন্দের মধ্যে। তাই মনে হয় একাত্তরের আগে আগে এই ভালোটা, মানে সাম্প্রদায়িক সংহতি অনেক বেশি ছিল, তাই ওই লুটের ঘটনা খুব বেশী করে চোখে পড়ছিলো, আর আজ চারিকে যখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে ওই ছেলেটার মিছিল থেকে দৌড়ে এসে দাদাকে সাবধান করার ঘটনাটা সমানে চলে আসে, যেমনটা কয়েকদিন আগে মৌলবাদীদের দ্বারা নাসিরনগর আক্রমণের সময় কিছু মুসলিম যুবকদের সংখ্যালঘুদের রক্ষার ঘটনা সবার দৃষ্টি কেড়েছে। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? অনেক সময় মনে হয় এই ২০১৬ তেও আমরা আবার সেই একাত্তরের দিনগুলোর মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি।
দুবনা, ২৪ নভেম্বর ২০১৬