একের পর এক ফিরে আসতে শুরু করলো গ্রামের ছিন্নমূল পরিবারগুলো। শুরু হলো আগাছা পরিষ্কার অভিযান। হাতুরী-বাটাল, করাতের শব্দে ভরে উঠলো গ্রামের আকাশ-বাতাস। সেই সময় তরায় হিন্দু আর মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। হিন্দুরা অধিকাংশই তাতের কাজ করতো অথবা ছিল ব্যবসায়ী। গ্রামের হিন্দুপাড়ায় ঘরগুলো ছিল মুলত টিনের চালের আর বেড়া ছিল বাঁশের। এই ঘরগুলির অধিকাংশই ছিল চৌরী ঘর মানে চার চালের ঘর। যাদের অবস্থা একটু খারাপ ছিল তাদের ছিল পাটখড়ির বেড়াদেয়া দোচালা ঘর। আর অবস্থাপন্ন লোকেরা ঘরের চাল-বেড়া সবই টিন দিয়ে করতো। এছাড়া কিছু কিছু বাড়িতে ছিল সানের মেঝে বা সিমেন্টের ভিত। যতদুর মনে পরে এ রকম ঘর ছিল মজুমদার বাড়িতে, যারা এক সময় এলাকার জমিদার ছিল, আর ছিল চুনী বসাক আর আমাদের বাড়িতে। পাকা ঘরের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা মাত্র কয়েকটা। তার একটা ছিল আমাদের ছোট ঠাকুরদা পুলিন সাহার (পি
সি সাহা) বাড়িতে। উনি ছিলেন আমাদের ঠাকুরদার ছোট ভাই। ঐ সময়ের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির এক ছেলে কোলকাতায় পড়তে গেলে অন্য কেউ সংসারের হাল ধরতো। আসলে ওইসব দিন মানুষ উচ্চ শিক্ষার জন্য কোলকাতা যেতো, পরে
যেমনটি গিয়েছিল আমার বড় জ্যাঠামশাই আর বাবা। তখনও ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হয়নি। পুলিন ঠাকুরদা যখন কলকাতায় সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং-এ পড়াশুনা করে, আমার ঠাকুরদা রীতিমত সংসার দেখে। যতদুর শুনেছি পুলিন ঠাকুরদা উত্তরবঙ্গে অনেক ব্রীজ তৈরি করেন। ঐ সময়ই উনি কোলকাতার বালিগঞ্জে পাঁচ তলা এক বিল্ডিং তৈরি করেন ঠাকুরদাকে না জানিয়ে। পরে এটা জানতে পেরে ঠাকুরদা বলেন “কোলকাতার বাড়ির দরকার নেই আমার। এখানে তোমার ভাগ তুমি
পাবে পুরোটাই।“ আর এই বলে পুলিন ঠাকুরদাকে তার অংশ দিয়ে আলাদা করে দেয়। পুলিন ঠাকুরদা আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পরে নতুন এক বাড়ি করে যা নয়াবাড়ি নামে পরিচিত। ওখানেই তৈরি হয় গ্রামের পাকা ছাদসহ প্রথম দালান। একাত্তরে ওটাই ছিল গ্রামের একমাত্র বিল্ডিং। ঠিক বলতে পারব
না, তবে মনে হয় পুলিন ঠাকুরদা শেষ পর্যন্ত দেশেই ছিল, কেননা ঠাকুরমাকে আমি দেখেছি যে
যুদ্ধের ঠিক আগে আগে মারা যায়। ঐ বাড়িতে থাকতো নয়াবাড়ির পিসিমা, কাকা আর জ্যাঠারা থাকতো
কোলকাতার বালিগঞ্জের বাড়িতে। ওঁদের সাথে আমার দেখা ১৯৬৯ আর ১৯৭২ এ যখন কোলকাতা গিয়ে
ঐ বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। এছাড়া আরও দুটো বিল্ডিং ছিল গ্রামে – পাকা দেয়ালের কিন্তু টিনের চালের। এর একটা ছিল জলিল চাচার, আরেকটা ছিল আমার বড় জ্যাঠার। গ্রামের মুসলমান পাড়ায় হাতেগোনা কয়েক বাড়িতে ছিল চৌরী ঘর, দোচালা ঘর ছিল অনেকেরই, তবে সিংহভাগ মানুষ বাস করতো ছাপরা বা একচালা ঘরে। এই লেখাটা যখন
লিখছি হঠাৎই একটা প্রশ্ন জাগলো মনে। ছোট বেলায় মনে হতো, এমনকি বলতামও আমাদের সব বাড়িতে
দালান করেনি, কারন যে কোন সময় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। আর টিনের ঘর ভাঙ্গা যত সোজা
দালান ততটাই কঠিন। কিন্তু এখন মনে হোল যুক্তিটা একেবারেই খোঁড়া। কেন না একাত্তরে টিনের
ঘরগুলিই ভেঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল, দালানগুলো কিন্তু ঠিক দাঁড়িয়ে ছিল। পালাতে যদি হয়ই
কি দালান, কি টিনের ঘর সব ছেঁড়েই পালাতে হয়। তাছাড়া বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর বা দেশত্যাগের
প্রশ্ন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যখন বাবা কাকাদের বয়েস ৩৫ এর উপরে। যতদুর জানি, আমার
ঠাকুরদার বাবা বা ঠাকুরদা ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে এখানে তালুক কেনে। যদি তাই হয়, তাদের
তো দালান করার মত আর্থিক সঙ্গতি থাকার কথা। শুধু আমাদেরই নয়, এলাকায় অনেক অবস্থাপন্ন
লোক ছিল কারো বাড়িতেই দালান ছিল না। যদিও আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন
জায়গায় কয়েকটা জমিদার পরিবার ছিল এবং তাদের অনেকের বাড়িতেই দালানকোঠা ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের
ব্যাপার এই, এর আগে কোন দিনই কথাগুলো এভাবে মনে হয় নি। অবশ্য বাড়ির অনেক কথাই আগে জানা
ছিল না। বাবা কাকারা কখনোই বলেনি যে তাদের তালুক ছিল, যদিও জানতাম অনেক জমিজমা ছিল।
কিছুদিন আগে আমার ছোট মেয়ে ক্রিস্টিনা ফ্যামিলি ট্রি করবে বলে আমাকে আমাদের পরিবার
সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি ওটা জানতে চাই ভাইদের কাছে। কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে এসব
খবর বেরিয়ে আসে। যাকগে আবার ফিরে আসা যাক যুদ্ধ পরবর্তী তরায়।
যুদ্ধের পর গ্রামের চেহারা বদলে গেলো। জানিনা ঠিক কি কারনে, ভ্যানেল কোম্পানি কাজ করতো বলে, নাকি অন্য কোন কারনে, যুদ্ধের পর অ্যামেরিকান সাহায্যে আমাদের গ্রামের হিন্দু পাড়ায় একশর মত কাচা বিল্ডিং তৈরি করা হোল। শুরু হোল এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। ওরা একশ পরিবারকে দিল সিমেন্ট, বালি আর কতগুলো মেশিন। সিমেন্ট আর বালি মিশিয়ে ঐ মেশিনে যে কেউ ইট তৈরি করতে পারতো। ইটগুলো ছিল বেশ বড়, সাধারন ইটের গোটা ছয়েকের সমান। ওগুলো পুড়ানোর দরকার পরতো না। এক বাড়িতে ইট তৈরির কাজ শেষ হলে মেশিন নিয়ে যেত অন্য বাড়িতে। আর ইট শুকালেই চলে আসতো রাজমিস্ত্রী। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রস্তুত হতো দোচালা টিন শেডের নতুন দালান। যাদের সামর্থ্য ছিল তারা নিজের খরচে দেয়ালে প্লাস্টার করে নিল। এই বিল্ডিঙের পাশাপাশি হিন্দুপাড়ায় অ্যামেরিকান সাহায্যে এলো স্যানিটারি টয়লেট। আর এসবের ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত হিন্দুপাড়া নতুন রূপ ধারন করলো, দেখা গেলো এতে করে হিন্দু ও মুসলিম পাড়ার অসাম্য কমলো না, বরং বাড়লো।
এমন এক দিনে গ্রামে আসলো ঝন্টু বেয়াইমশাই তার দলবল নিয়ে মার্চ করতে করতে। এটা ছিল মুক্তিসেনার দল। ওরা এসেই গ্রেফতার করলো বাঘা খলিলকে পাকবাহিনীকে সহযোগিতার কারনে। সে কথা জানতে হলে আবার
আমাদের ফিরে যেতে হবে মার্চের শেষ দিনগুলোতে। আমি যখন লেখা শুরু করি, তখন মুলত সেটা
করেছি নিজের স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে। আমার লেখাগুলো পড়ে একদিকে যেমন আমার অনেক
বন্ধুরাই ফিরে গেছে একাত্তরে, সেটা হয়েছে ভাইদের ক্ষেত্রেও। তারাও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি
খুজতে শুরু করে, কখনো সখনো আমাকে বিভিন্ন তথ্য দেয়, যেটা আমাকে সাহায্য করে ঘটনার ধারাবাহিকতা
ঠিক রাখতে। কিছুদিন আগে যখন দেশে যাই তখন চেষ্টা করেছিলাম অনেকের সাথে কথা বলতে, তবে
তেমন সাড়া পাইনি। তবে মস্কো ফেরার পর টেলিফোনে কথা বলে আর লিখিত বক্তব্য পেয়ে অনেক
কিছুই জানতে পাই। এগুলো হয়তো “বাড়ি ছাড়ার পালা” বা “একাত্তরে তরা” পর্বে অন্যভাবে সাজিয়ে
লেখা যেত, তবে আমার মনে হয় এখানে লিখলেও ক্ষতি কিছু হবে না, যদিও কিছু কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি
হতে পারে। গ্রামের যে দুই বড়ভাই তথ্যগুলো দিয়েছে, তাদের ইচ্ছাক্রমে নামগুলো উল্লেখ
করছি না।
আগেই বলেছি, ২৬ শে মার্চ কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন
ঘুমন্ত নগরীর উপর নির্বিচারে গুলি চালায় তখন ঢাকা থেকে মানুষের ঢল নেমে আসে রাস্তায়,
তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে গ্রাম বাংলায়। বাংলার গ্রাম দুহাতে বুকে টেনে নেয়
তাদের। গ্রামের মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের মুখে তুলে দেয় নিজেদের পাতের ভাত। তরার মানুষও
ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। সড়কের পাশে সিএনবির জমিতে তৈরি হয়
লঙ্গরখানা। স্বতস্ফুর্ত যারা এ কাজে এগিয়ে আসে তারা হোল শ্যামল সাহা, উমেশ সাহা, তপন
সাহা, জীবন বসাক, আনন্দ সাহা, রমেশ বসাক, কৃষ্ণদাস বসাক, সুশীল বসাক, সুনীল বসাক, গোপাল
বসাক যারা সবাই তরা নবীন সংঘের ব্যানারে কাজ করছিল। আরও ছিলো হোসেন আলী, নূর মোহাম্মদ,
শেখ ইমান আলী, মোঃ মইনুদ্দিন, আসগর আলী। এর বাইরেও আরও কিছু লোক ছিল যাদের কথা মনে
নেই। জনা দুয়েক বাদ দিলে এরা সবাই ছিল কলেজের ছাত্র। এটা আবার প্রমান করে বাহান্ন থেকে
শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত সমস্ত আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল ছাত্র সমাজ।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে জনৈক বিহারী ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে
ঢাকা যাবার পথে ফেরী ঘাটে গ্রামের যুবকদের নজরে পড়ে। সেই ড্রাইভারকে ধরে গ্রামেরই এক
যুবকের উপর দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে মানিকগঞ্জ নিয়ে হালিম ক্যাপ্টেনের হাতে সোপর্দ করার
জন্য। কোন এক অজ্ঞাত কারনে সে ছেলে বিহারী ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়। পরের দিন ভোরে কৃষকেরা
দক্ষিণ চকে গিয়ে দেখতে পায় শত শত সৈন্যে ছেয়ে গেছে চক। রাতে হেলিকপ্টারে করে ওদের নামিয়ে
দেয়া হয়েছে। অপর দিকে স্থলপথে শত শত সৈন্য জমা হয়েছে নদীর উত্তর তীরে। পরে জানা গেছে
সেই বিহারী ড্রাইভার ঢাকা গিয়ে বলে যে তরায় শত শত মুক্তিবাহিনী কাজ করছে, তাই এত আর্মি
পাঠানো হয়েছে চারিদিক থেকে গ্রাম ঘিরে ফেলার
জন্য। এতদিন পর্যন্ত আমরা নিজেরা বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু ওইদিন যখন আর্মি চলে আসে আর
গ্রামের বিভিন্ন দিকে পজিশন নেয়া শুরু করে গ্রামের হিন্দুরা বাড়িঘর ছেঁড়ে পালিয়ে যায়
যে যার মত। সাথে নেয় টাকা-পয়সা আর সোনাদানা, পেছনে রেখে যায় ঘরবাড়ি, বাসনকোসন আর চিরদিনের
স্মৃতি।
ইপিআরটিসির ড্রাইভার পাবনার হারুন ড্রাইভারসহ গ্রামের কিছু
লোক আর্মিকে সহযোগিতা করতে শুরু করে। যারা আর্মিকে সহযোগিতা করে তাদের মধ্যে বিহারী
ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়া ছেলেটি ছিল আর ছিল বাঘা খলিল। তার মাত্র দু’তিন দিন পরে বাঘা
খলিল অন্যদের নিয়ে বলাই গোঁসাই আর তার বৌকে ইঁদারায় (কুয়া) ফেলে ইট-পাথর ছুড়ে হত্যা
করে। এই ঘটনার দিন দু’এক পরে জগাই আর নিরা – দু ভাইকে আর্মি গুলি করে হত্যা করে ওদের
কাছ থেকে খবর পেয়ে। যুদ্ধের পর বাঘা খলিলকে ধরে নিয়ে যাবার কারন ছিল এটাই। যত দুর মনে
আছে, খলিল চার পাচ বছর জেল খেটে পরে গ্রামে ফিরে আসে। পরবর্তীতে আমরা এক সাথে খেলাধুলা
করতাম। ঐ সময় গ্রামের ছোট বড় সবাই এক সাথে ফুটবল খেলতাম। এ ছাড়া ও বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরি
করে তা বিক্রি করে সংসার চালাতো।
আর্মি তরায় সেই যে এল, এরপর থেকে ওখানেই ঘাটি গড়ে বসে ভ্যানেল
কোম্পানির অফিসে। গ্রামের কিছু লোক সক্রিয় ভাবে ওদের সাহায্য করে। কিছু লোক বাধ্য হয়
শান্তি কমিটিতে যোগ দিতে। আবার কিছু লোকের উপর আর্মির পক্ষ থেকে বিশেষ নজর রাখা হয়।
সক্রিয় লোকগুলোর উদ্যোগেই শুরু হয় হিন্দু পাড়ায় লুটপাট। যদিও গ্রামের অনেকেই পরে সেখান
থেকে ঘটিটা-বাটিটা নিয়ে যায়, তবে এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল রিফ্লেকটিভ, মানে যেহেতু
পরেই আছে, আমি না নিলে অন্য কেউ নিয়ে নেবে – তাই নেয়া আর কি। এই আর্মিরাই তরায় গড়ে
তুলে বধ্যভুমি। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে এখানে হত্যা করা হয়। প্রায় প্রতিদিনই
গভীর রাতে শোনা যেত মানুষের করুন আর্তনাদ আর গুলির শব্দ। এটা ঘটতো রাত ১২ টা ১ টার
দিকে। পরের দিন হাত-পা বাঁধা বা বস্তা বন্দী বা পেরেক লাগানো লাশ ভাসতে দেখা যেত কালিগঙ্গায়।
বহু লাশ ফেলে দেয়া হতো নির্মাণরত ব্রীজের পিলারের ঘেরে। হারুন ড্রাইভার যুদ্ধের পর
পালিয়ে যায়, তাকে আর কোন দিন দেখা যায়নি। শুনেছি তার ছেলে এখন বড় লীগ নেতা। খলিল জেল
খেটেছে, কিছু দিন আগে মারাও গেছে। যারা সক্রিয় ভাবে আর্মিকে সাহায্য করেছে তাদের আর
কেউ তাদের কৃত কর্মের জন্য কোন শাস্তি পেয়েছে বলে জানা নেই, যদিও তাদের অনেকেই আজ আর
বেঁচে নেই।
এই পর্বটা লিখতে লিখতে আমার এক নতুন উপলব্ধি হোল আমার গ্রামের
মানুষদের সম্পর্কে। এতদিন ভাবতাম একাত্তরের ঐ দিনগুলোতে হাতেগোনা কয়েক ঘর বাদে গ্রামের
প্রায় সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায় লুটতরাজের সাথে জড়িত ছিল। এখন দেখছি ব্যাপারটা একেবারেই
তেমন নয়। উলটো, হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র পাকবাহিনীর সক্রিয় সহযোগী ছিল। অন্য অনেকেই যারা
ঘটিটা-বাটিটা নিয়েছিল, ওগুলো মূলত ছিল লুটের উচ্ছিষ্ট। তাছাড়া লুট করলেই তো হবে না,
সেটা হজম করার শক্তিও দরকার। দু’এক জন রাঘব বোয়াল বড় বড় ঘর আর আসবাবপত্র নিলেও সাধারন
মানুষের পক্ষে সেটা তত সহজ ছিল না। যার বাড়িতে কোন রকমে একটা ছাপরা ঘর তোলা যায়, সে
বড় চৌরী ঘর নিয়ে করবে কি? বাসনকোসন নিয়েই বা কি করবে, যদি না তা বিক্রি করা যায়? আর
কে কিনবে তখন লুটের মাল? আমার তো এখন মনে হয়, গ্রামের সাধারন মুসলমান, যারা পাকবাহিনীকে
সক্রিয় সহযোগিতা করে নি তাদের দিন আমাদের চেয়ে কম উৎকণ্ঠায় কাটেনি। আমরা ছিলাম আর্মির
ধরাছোঁয়ার বাইরে, ওরা আর্মির নাগালের মধ্যে। কাজ ছিল না, বিশেষ করে যারা হিন্দু বাড়িতে
কাজ করতো, তাদের। যুদ্ধের পরে সবাই ফিরে এলে এরা যে শুধু ঘটিবাটি ফেরৎ দেয় তাই নয়,
এদের নানা রকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয়, সন্দেহের শিকার হতে হয়। আসলে কী যুদ্ধ, কী শান্তি
গরীব মানুষ সব সময় খারাপ থাকে। ভালো থাকে হাতেগোনা কিছু মানুষ, যারা ক্ষমতাসীনদের আশপাশ
দিয়ে ঘোরাফেরা করে। সেটা আগেও ছিল, এখনো আছে। আর তাই তো সরকার আসে সরকার যায় আর এই
সব লোকেরা সবসময় ভালো থাকে, সরকারের পক্ষে থাকে। এটা গল্পে অমর দানোর (কাসেই বেসস্মেরৎনি)
প্রান থাকে সুচের ডগায়, সুচ থাকে ডিমে, ডিম হাঁসের পেটে, হাঁস সিন্দুকে, সিন্দুক গাছের
মাথায় যেটা পাহারা দেয় মস্ত বড় ভালুক। বাস্তবে এটা আমাদের, সাধারন মানুষের প্রান থাকে
সুচের ডগায় যার মালিক সরকারী আর বিরোধী দলের মাস্তানরা। ওদের দিয়েই হয় ক্ষমতার হাতবদল,
আর মাঝখান থেকে সাধারন মানুষ, যাদের উপর কিছুই নির্ভর করে না, এমন কি নিজের ভালোমন্দ
কিছুই, তারাই বারবার হয় বলীর পাঁঠা।
যাই হোক যুদ্ধের পর তরায় আবার শুরু হোল নতুন জীবন, গড়ে উঠলো
সমিতি, এ যেন বিপ্লবের পর নতুন করে জেগে ওঠা, নতুন করে আবার হাঁটতে শেখা, নতুন করে
জীবন শুরু করা। সে কথা পরে।
মস্কো-দুবনা, ২৭ – ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭