Sunday, December 11, 2016

২৮ ফিরে এলাম বাঙ্গালা

এবার যখন দেশে আসি মস্কো বসেই প্ল্যান করেছিলাম একাত্তরে পালিয়ে  কাটানো ওই গ্রামগুলো দেখতে যাবো।  তাই ২৮ নভেম্বর যখন বাড়ি এলাম, পরের দিনই মানিকগঞ্জ গিয়ে দেখা করলাম বাসেতের সাথে।  বাসেত কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে, এখন ওকালতি করে মানিকগঞ্জ।  দেখে খুব খুশি হলো। তবে মনে হয় আমরা যতটা না নিজেদের চিনি তার চেয়ে বেশী  চিনি আমাদের বাবাদের। আর আমাদের  চেনা বা জানা - মানেই বাবাদের কাছে শুনে চেনা।  ওরা  আমার কাছে যতটা না রাশেদ-বাসেত, তার চেয়েও বেশী  কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে, ঠিক তেমনটাই আমিও হয়তো ওর কাছে বৃন্দাবন সাহার ছেলে।  তাই হয়তো কথায় কথায় বললো, "বাবা বলতো, আমি জীবনে বৃন্দাবন সাহার বাড়ী  ছাড়া কোনো হিন্দু বাড়ী  খাই নাই, কিন্তু ওই বাড়ীতে  খেতে বসে মনে হয়েছে, যেন নিজের বাড়ীতেই  খাচ্ছি। " আসলে এমনটাই হয়, মানুষ যখন একে  অন্যকে  ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, তখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ সব দূরে সরে যায়, সব কিছু ছাপিয়ে  তার  সামনে এসে দাঁড়ায় শুধুই ওই মানুষটা - ভালোবাসার বা শ্রদ্ধা করার অথবা  ঘৃণা করার।  ওর কাছ থেকেই এলাকার কমবেশী  খোঁজ খবর নিয়ে ঠিক করলাম, কয়েক দিনের মধ্যেই যাবো বাঙ্গালা  আর ওখান থেকে বৈলতলা।  ও বার বার বলে দিলো আমরা যেন অবশ্যই ওদের বাড়ী  যাই আর যাবার আগে ওর ভাই রাশেদকে টেলিফোন করি, নইলে খুব মাইন্ড করবে।

৫ই ডিসেম্বর বারোটার দিকে বেরুলাম বাঙ্গালার পথে।  প্রথমে ভেবেছিলাম ট্রলারে করে প্রথমে বৈলতলা যাবো, ওখান থেকে পরে যাবো বাঙ্গালা।  খোঁজ নিয়ে জানা গেলো জলের অকাল, তাই ট্রলারে গেলে হাটতে হবে অনেকটা পথ, আবার একাত্তরের মতোই মাঠের পর মাঠ  পেরিয়ে যেতে হবে ওদিকটায়।  তাই ঠিক হলো, প্রথমে বাসে  করে  করে যাবো ঘিওর,  ওখান থেকে হ্যালো বাইকে প্রথমে বাঙ্গালা  আর তার পর বৈলতলা।  তবে বাস ফেল  করায়  ঘিওর গেলাম   সি এন  জিতে সারা রাস্তা ঝাকুনি খেতে খেতে। মাইল্যাগী  দিয়ে যাবার সময় মনে করলাম কোথায়, কোন বাড়িতে ছিলাম আমরা।

ঘিওর থেকে হ্যালো বাইকে করে রওনা হলাম বাঙ্গালার  দিকে। প্যাসেঞ্জাররাই বলে দিলো ওখান থেকে কিভাবে বৈলতলা যাওয়া যায়।  কথায়  কথায়  জানালাম আমাদের আসার উদ্দেশ্য, জানলাম কি কি পরিবর্তন হয়েছে এলাকায়।  ওখানেই ধামসরের একজনকে পাওয়া গেলো। ওনার কাছ থেকে জেনে নিলাম ওই এলাকার খবর।  গল্প করতে করতে ঘিওর থেকে আমরা এসে পৌছুলাম বাঙ্গালায়।  

হ্যালো বাইক থেকে নেমে দেখি কে যেন একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।  চিনতে কষ্ট হলো না।  কুদ্দুস ভাইকে মনে করিয়ে দিলো।  ও রাশেদ, খবর পেয়ে  এসেছে আমাদের নিয়ে যেতে।  হাটতে হাটতে চললাম ওর পেছন পেছন।  নতুন রাস্তা চলে গেছে বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে। ফলে একদা যেখানে ছিল সবুজ মাঠ  এখন সেখানে ডোবা আর ডোবা, বলা যেতে পারে খাল, তবে তা জাল দিয়ে ভাগ করা যেমনটা আল দিয়ে ভাগ করা থাকে মানুষের জমি।  ডোবাগুলো জলে ভর্তি, এখানে সেখানে ভাসছে পানা  আর তার নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো কালো মাছ।  এখন আর এখানে ফসল  চাষ হচ্ছে না, হচ্ছে মাছের চাষ।

দেখতে দেখতে চলে এলাম শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ীর  সামনে।  মনে পরে গেলো সেই মাইট্যালটার  কথা।  ওটা আজ আর আগের মতো নেই, আশেপাশের ডোবাগুলোর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।  বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক চাচা।  রাশেদই  আলাপ করিয়ে দিলো।  উনি এখন এই বাড়ীর  মালিক।  বললাম, একাত্তরে আমরা এ বাড়িতে ছিলাম।  আমাদের ডাকলেন, বেরিয়ে যেতে বললেন।  সময় ছিল না।  তা ছাড়া বাইরে থেকেই দেখলাম, বাড়ীর  শুধু মালিকানায় পরিবর্তন হয় নি, বাড়ীর  ঘরগুলোর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। স্মৃতিতো শুধু মাটি নয়, সেখানকার মানুষ, ঘরদোর আরো কত কিছু।  তাই আর ওখানটায় যেতে ইচ্ছে করলো না।  চললাম সামনের দিকে।  আগে, একাত্তরে শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ীর  সামনে ছিল মাঠ  আর মাঠ - এখন অনেক নতুন বাড়ীঘর  উঠে গেছে।  যদিও আমার নিজের গ্রাম তরায় ঘরে ঘরে ভোরে গেছে মাঠ  ঘাট, তবুও এই বাঙ্গালায়  সেটা দেখে অবাকই লাগলো।  অবাক হয়ে দেখলাম জমির ধার দিয়ে চলে যাওয়া সেই রাস্তাটা মাটি চাপা পড়েছে।  এখানেও উন্নতির জোয়ার - নতুন রাস্তা নতুন জীবন।  তবে পাশে হেটে যেতে যেতে কে যেন বললো, আগের রাস্তাই  ভালো ছিল, নিচু, কিনতু  সমান।  এখন রাস্তা উঁচু করেছে ঠিকই, তবে এখানে গর্ত তো ওখানে উঁচু মাটির ঢিবি।  আসলে উন্নয়নের ব্যাপারটাই,  খুবই অসমান, বিশেষ করে আমাদের মত  দেশে - কেউ কেউ উন্নতির শিখরে বসে থাকলেও অধিকাংশই পরে থাকে কানাগলিতে।  জীবন চলার পথে প্রায়ই হোঁচট খায়, যেমনটা এখানকার মানুষ রাত বিরাতে  হোঁচট খায় এই উঁচু কিন্তু অসমান  পথে।

অবাক হলাম দেখে যে গ্রামের বাজারটা শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ী  থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরে।  ওই সময় মনে হতো বাজারটা যেন দিগন্ত পেরিয়ে। মনে হয়  পাগুলো আমার  তখন খুব ছোট ছিল আর ছোট ছিল পদক্ষেপগুলো।  বাজারটা অনেকটা আগের মতোই আছে, তবে ওই দিন, মানে সোমবার হাট ছিল বলে ধীরে ধীরে লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে।

আরো অনেকটা পথ পেরিয়ে রাশেদ নিয়ে এলো আমাদের ওদের বাড়ীতে।  আগে শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ী  থেকে মাত্র কয়েকটা  বাড়ী  পেরুলেই চলে যাওয়া যেত ওদের ওখানে, এখন উঁচু রাস্তা ধরে যেতে যেতে পার হয়ে এলাম প্রায় এক কিলোমিটার পথ।  শহরে উন্নয়ন এনেছে যানজট, গ্রামে ঘোরা  পথ।

কুদ্দুস ভাইদের পুরানো বাড়ীটা  সরে এসেছে নতুন জায়গায়, পাশেই।  ওই সময়ের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয় সেই তাল গাছ আর গাব  গাছ।  রশিদের এখনো মনে আছে, ওই আবার মনে করিয়ে দিলো, দেখালো গাছগুলো।  তবে বড় বড় সেই আম  গাছগুলো আর নেই, যেমনটা নেই বাজারের সেই বট গাছটা। ওই সময় কুদ্দুস ভাইয়ের বাড়ীর পেছনে দাঁড়িয়ে তেরশ্রী পর্যন্ত দেখা যেত, এখন অনেক নতুন বাড়ীঘর আটকে দেয়  দৃষ্টিকে।

আমার সব সময়ই খালেক নামটা মনে পড়ছিলো, তবে বাড়ীর  কারোই মনে ছিল না।  রশিদ আসলো সাহায্যের হাত নিয়ে।  খালেক ছিল কামাক্ষার বনধু যে হরহামেশা গান বাঁধতো।  রাশেদের ছেলেমেয়েরা কেউই আর গ্রামে থেকে না, ওরা  দুজনেই  এখন এখানকার বাসিন্দা।  আদর করে দই আর মিষ্টি খাওয়ালো - তেরশ্রীর দই মিষ্টি, যা এলাকায় খুবই নাম করা।  ও হয়তো ভেবেছে আমরা ওর ওখানে ভাত  খাবো না, তাই এই ব্যবস্থা।  দিন পাল্টে গেছে, আমরা এখন সব জায়গাতেই খাই।

অনেক গল্প করলো রাশেদ।  পুরানো প্রতিবেশীদের গল্প। কামাক্ষা, রাম  মামা, বাদল দা  আরো কত নাম।
- সেই দিন আর নাই কাকা।  সেই মানুষও নাই।  আশেপাশের যে সব হিন্দু বাড়ী  ছিল, অনেক আগেই চলে গেছে।  এসেছে  নতুন  মানুষ, কিনতু তাতে পরিবেশ ভালো হয় নাই।  এখনতো পাহারা ছাড়া ঘুমানোই যায় না।  আজ চোর আসে তো কাল ডাকাত।  পাহারা দিতে হয় রাত  জেগে।
- কেন? এখন তো রাস্তাঘাট কত উন্নত হয়েছে, চাইলেই ঘিওর যেতে পারো ২০ মিনিটে।  কারেন্ট, দোকানপাট, মোবাইল ফোন ...
- এগুলোর দরকার আছে ঠিকই, তবে মনে শান্তি দরকার, স্বস্তি দরকার।  মানুষ দরকার, যাদের  কাছে যাওয়া যায়, যাদের সাথে কথা বলা যায়। ওই মানুষ এখন কোথায় পাবো কাকা?      

আমারও  তাই মনে হয়, দেশের উন্নতি কেন যেন শুধু অর্থনৈতিক সেক্টরেই আটকে গেছে।  অনেকটা নিত্যতার সূত্র ধরে সেই সাথে শিক্ষা (একাডেমিক শিক্ষা নয়) , সংস্কৃতি, নৈতিকতা  এসব ব্যাপারে আমরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছি।  যে ভাষা আর সংস্কৃতির  জন্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, আজ আমরা একটু একটু করে সেই ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।  অবশ্য হতে পারে এটা আমার দেখার ভুল। হয়তো তাই কেউ কেউ  মনে করে যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চমৎকার স্মৃতিচারন বিষয়ক আমার লেখাগুলো অত্যন্ত উপভোগ্য হলেও  গল্পের শেষে,  কিছু বিমূর্ত  বিষয় দাড় করিয়ে আমি নাকি  ঢালাও ভাবে নিজের (?) সমাজ-জাতি তথা দেশের ওপর  সাম্প্রদায়িকতার   তকমা এটে দেই  যা  কোন বিজ্ঞানের মাঝেই পরেনা।

আমার অবশ্য তেমনটা মনে হয়না।  একাত্তরকে নিয়ে লিখতে হলে শুধু যে সেই টাইম-ফ্রেমের মধ্যেই থাকতে হবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না।  তছাড়া আমি ইতিহাস লিখছি না, লিখছি সেই সময়ে ও আমার পরবর্তী চিন্তা ভাবনায় একাত্তরের প্রভাব, একাত্তরের ঘটনাবলীর প্রভাবের কথা।  বিজ্ঞানের  বিশেষ করে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হবার ফলে আমি ভালো বা মন্দ  সব জিনিষকে  প্রশ্ন করেই গ্রহণ করি।  হতে পারে সব সময় আমার সিদ্ধান্ত সঠিক না, বা অন্যদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, তবে তার পরেও ওই সত্য বা মিথ্যা আমার একান্তই নিজের, নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার বিচারে গৃহীত।  যদি আমি সেটা না করে অন্যদের কথায় কোনো কিছুকে সত্য বা মিথ্যা বলে গ্রহণ করতাম, তা হতো তাদের সত্য বা মিথ্যা - যার প্রতি আমার থাকতো শুধুই বিশ্বাস, যুক্তি নয়।    

যদিও হাটছিলাম আমি বাঙ্গালার রাস্তায় ২০১৬ সনের  ৫ ই ডিসেম্বর, আমি যেন তখন অবস্থান করছিলাম সমান্তরাল বাস্তবতায় - বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম ফেলে আসা সেই একাত্তরে।  এই নতুন বাস্তবতা দুহাতে সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো একাত্তরের সেই বাঙ্গালা, যেখানে কুদ্দুস  ভাই, শশী জ্যাঠামশায়, রাম  মামা, কামাক্ষা,  আরো অনেক অনেক মুখ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো।

তরা,  ১১ ডিসেম্বর ২০১৬


Sunday, December 4, 2016

২৭ অসুস্থ অসাম্প্রদায়িকতা


ঠিক মনে নেই কবে,  তবে একাত্তরের ওই দিনগুলোতেই একদিন বড় মামা বেড়াতে এলো বৈলতলায়। বড় মামা - আমার মার জ্যাঠাতো ভাই - মাদের  ভাই-বোনদের মধ্যে সব থেকে বড়।  মামা থাকতো মির্জাপুর।  বড়  মামা মার দিক থেকে আমাদের একমাত্র ঘনিষ্ট আত্মীয় যে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানে রয়ে গেছিলো। আমার বাবা-কাকারা কেউই প্যান্ট-শার্ট পড়তো না, ধুতি-পাঞ্জাবী  পরেই সারাজীবন কাটিয়ে দিলো।  মামা চাকরী  করতো থানার কৃষি ডিপার্টমেন্টে, তাই প্যান্ট-শার্ট পড়তো।  সব সময়ই ফিটফাট থাকতো।  সিগারেট খেত প্রচুর আর চা।  তবে আমাদের চা খাওয়াতে আপত্তি করতো না।  বড়  মামার বাবা, মানে মার  জ্যাঠা ছিল ঠিক উল্টো।  উনি থাকতেন পশ্চিবঙ্গের গুপ্তিপাড়া।  যদি কলকাতা থেকে আমরা হাওড়া স্টেশন হয়ে বহরমপুর মাসীর  বাড়ী  যেতাম,  বুঝতাম, পথে গুপ্তিপাড়া নামবো, আর শিয়ালদহ থেকে যাওয়া মানে সোজা  মাসির ওখানে।  সেক্ষেত্রে    উল্টো পথে আমরা গুপ্তিপাড়া যেতাম।  ওই যাওয়াটা আমার জন্য সব সময়ই ছিল এক  বিরাট চ্যালেঞ্জ, কেননা যতদিন নিজেকে মনে পরে, চা ছাড়া আমি নিজের সকাল-বিকাল কল্পনাই করতে পারিনা।  চা আমার জন্যঅনেকটা জীয়ন কাঠির মতো।  দাদু বাচ্চাদের চা খাওয়া একেবারেই বরদাস্ত করতো না, সকালে উঠে বড়রা যখন চা খেতো  আমাদের ভাগ্যে জুটতো হরলিক্স।  মনে পরে, মা তখন আমাকে দাদুর সামনে হরলিক্স দিয়ে পরে গোপনে দেয়ালের বাইরে চা নিয়ে আসতো।  অন্য সব দিকে  দাদু  ছিল খুব ভালো মানুষ।  হাসি-খুশী।  আর বড় মামা  ছিলো  গম্ভীর প্রকৃতির। এমনকি যুদ্ধের আগেও আমাদের বাড়ী  খুব বেশি একটা আসতো  না, তাই এই মামাকে হঠাৎ করে বৈলতলা দেখে   অবাকই হই।

মামা যখন এলেন, যুদ্ধ চলছে পুরাদমে।  প্রায়ই দেখতাম বাবা-কাকা আর জ্যাঠামশাইয়ের সাথে বসে কথা বলতেন যুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে।  অনেক সময় মা-মেঝমারাও আলোচনায় অংশ নিতো।  সবারই মনে প্রশ্ন এইযুদ্ধ নিয়ে,  এড়ানো যেত কিনা এই যুদ্ধ?  বেশি দিন আগের কথা নয়, সবে মাত্র দেশ ভাগ হয়েছে, লাখো  মানুষের রক্তের বন্যায় নেয়ে  জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান - দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে।  আর এর যাঁতাকলে পিঁষে  মরেছে দুদেশেরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।  স্বাধীন পাকিস্তানেও ওই প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বিভিন্ন অজুহাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের। এমনকি যুদ্ধের সময়    হিন্দুরাই মূলতঃ  হয়েছে আক্রমণের শিকার।  তাই অনেক সময়ই বড়দের  কথায় বার্তায় প্রশ্ন এসেছে, অবশ্যম্ভাবী ছিল কি ভারত বিভাগ? অনেকের ধারণা এটা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। মাসুদের ভাষায়

"আমাদের উপমহাদেশ কোনসময়ই একটা দেশের মতো ছিলো না। ছিল উপমহাদেশীয়  সাম্রাজ্য, যা সবচেয়ে বেশী বিস্তার পেয়েছিলো মৌর্য, গুপ্ত আর ব্রিটিশদের সময়ে। তাদের সবারই ছিল  বিভিন্ন কৌশল সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা। আর ব্রিটিশরা যেহেতু সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবচেয়ে বেশী ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। তাদের কাছ থেকে ভালো খারাপ মিলিয়ে অনেক নতুন কিছু ও পেয়েছি। আর ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগের বীজ বুনা হয়েছিলো সিপাহী আন্দোলনের সময়। .............."

এভাবে অনেকেই ভাবেন আর যেহেতু দেশটা ভাগ হয়েই গেছে, তাই এর অবশ্যকীয়তা বা অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্নটা বেমানান।  তবে আমি যেহেতু সমাজবিজ্ঞানী নই, পদার্থবিদ, তাই ওই দৃষ্টিভঙ্গী  থেকেই ব্যাপারটা দেখবো আর দেখবো যতটা না ভারত বিভাগ, তার চেয়েও বেশী  করে ওই বিভক্তির মধ্যেই যে স্বাধীন বাংলার বীজ নিহিত ছিল সে ব্যাপারটা।

ভারত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ  বা রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত হলেও সব সময় তার এক আলাদা আইডেন্টিটি ছিল, যেমনটা আছে ইউরোপের।  যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজবংশ ভারতকে তাদের শাষণে এনেছেন, তা মূলতঃ  ছিল রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি মূলতঃ  করদানের মধ্যেই সীমিত ছিল।  ব্রিটিশরাই প্রথমে সারা ভারতকে একটা একক অর্থনৈতিক কাঠামোতে নিয়ে আসে।  মুম্বাই, কলকাতা আর চেন্নাইয়ের মতো বড় বড় শহর স্থাপনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে ওতপ্রোতভাবে বেঁধে ফেলে। আর এই বন্ধন ধর্মীয় বন্ধন থেকে অনেক কঠিন। তাই অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভরতের টিকে থাকা ছিল একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে রাখার থেকে অনেক কঠিন। এছাড়া একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার।  যেকোন জিনিষই  একে  অন্যের সাথে জড়িত থাকে পাস্পরিক প্রতিবেশী এলাকাগুলোর মাধ্যমে।  পায়ের সাথে যেমন মাথার যোগাযোগের জন্য শরীরের অন্যান্য অংশগুলোর দরকার, দেশের ক্ষেত্রেও  তাই। একটু খেয়াল করলে দেখবো, চিটাগংয়ের ভাষার সাথে রোহিঙ্গাদের ভাষার  অনেক মিল, একই ভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার লোকদের কথা-বার্তা চলন-বলন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার লোকজনের সাথে খুব বেশী  করে মিলে  যায়। একই কথা খাটে প্রতিটি অঞ্চলের ক্ষেত্রেই। এই ভাষাগত, ব্যবহারগত মিলগুলো এক ধরণের আঠা হিসেবে কাজ করে এক বৃহত্তর গোষ্ঠীকে একসাথে ধরে রাখতে।  তাই ভারত ভেঙে পাকিস্তান যখন তৈরী হয়, এর দুই অংশের মধ্যের  সেই আঠা উবে যায়। দুটো মানুষের সম্পর্ক যেমন শুধুমাত্র একটা জিনিসের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে পারে না  (সে সম্পর্কটা হয় বিজনেজ সম্পর্ক)  ঠিক তেমনিভাবে শুধু মাত্র ধর্মের উপর নির্ভর করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে  সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জনগোষ্ঠী একই রাজনৈতিক পতাকায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না।  তাই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ যখন ভাগ হলো, দ্বিজাতি তত্ব তখন তার আকর্ষণ হারালো পাকিস্তানের ভেতর।  ওই তত্ব বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে এফেকটিভ হলেও, সমাজ গঠনে একই ভাবে কাজে লাগে না।  তাই বিভিন্ন সময়ে ভারতবিরোধী শ্লোগান তুলে, সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধের মহড়া দিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশভাগকে ঠেকিয়ে রাখা গেলেও বাংলাদেশের জন্মটা ছিলো অবশ্যম্ভাবী। তাই আমার মনে হয় বাবা-কাকা-মামাদের আলাপে যে দেশভাগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কারণ হিসেবে উঠে এসেছিলো, ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

তাই স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন, যেটা গড়ে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে, তা ছিল দ্বিজাতি তত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব বাঙালীর  অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন,  ধর্মীয় পরিচয়টাই আমাদের সার্বিক মিলনে এক বাধার সৃষ্টি করেছিল, এক জাতি, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির ধারক হওয়া  সত্যেও  আমাদের মধ্যে বিভেদের বীজ ঢুকিয়েছিল।

দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের   ভিত্তিতে তাই পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা আর ইন্ডিয়া থেকে মুসলমানেরা স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, তবে সেটা মূলতঃ  ঘটেছে পাঞ্জাব আর বাংলায় - দেশের সাথে সাথে যে প্রদেশগুলোও বিভক্ত হয়েছিল। তাই ধর্মভিত্তিক দেশান্তর ঘটলেও এই দুই প্রদেশ বিভক্ত না হলে দেশত্যাগ বা দেশ থেকে বিতাড়নের স্কেলটা অন্যরকম হতো বলেই আমার বিশ্বাস।

তাই আমার মনে হয় দেশভাগ যতটা না স্বতঃসফুর্ত তার চেয়ে বেশি করে চাপিয়ে দেয়া।   আর চাপিয়ে দেয়া বলেই মানুষ বেশীদিন  সেটা মেনে নেয়নি, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে সবার জন্য এনেছে স্বাধীনতা। কিনতু  তার পরও  আমরা আবার কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোলাজলে আটকে পড়লাম? ক্ষমতার লোভ আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে।    

গত সোমবার এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ী  ফেরার পথে শুনলাম বিধানকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।  বিধান আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে, আমার থেকে একটু ছোট, তবে একই সাথে ডাংগুলি  খেলে বড় হয়েছি আমরা, ছোট বেলা থেকেই  যখন যা  দরকার - করে দিতো, আমরাও   বাড়ীর  লোকের মতোই ভালোবাসতাম ওকে।  শুনলাম বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর  ছিল।  গরিবের যেটা হয়, ভেবেছিলো সেরে যাবে, সারেনি। তাই এই সরকারী  হাসপাতালে ভর্তি হওয়া  . পরের দিন মানিকগঞ্জ কমরেডদের সাথে দেখা করতে যাবার পথে ওর ওখানে গেলাম।  দেখে মোটেই ভালো লাগছিলো না।  চারিদিকে রুগী দিয়ে ভর্তি।  অল্পবয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ দিয়ে ভর্তি জায়গাটা।  অধিকাংশই গরীব।  পোশাক আশাক আর অসুস্থতা - সব মিলে  চিৎকার করে দারিদ্র্যকে জানান দিয়ে যাচ্ছে।  তার পরেও একটা জিনিস আমার মনে আশা জাগালো - পোশাক দেখেই বুঝলাম - এখানে হিন্দু-মুসলিম শুয়ে-বসে আছে পাশাপাশি বেডে।  অনেকদিন পরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একটা ছবি দেখলাম, অসামপ্রদায়িক, কিনতু  অসুস্থ বাংলাদেশের ছবি। উপযুক্ত ডাক্তার, ওষুধ আর চিকিৎসার অভাবে অনেক রুগীই জীবনের শেষ দিন গুনছে।  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশও তেমনি অপেক্ষা করছে সুস্থ রাজনীতির, নির্ভীক ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের।  আসবে কি সেই দিন?

তরা, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬




Thursday, November 24, 2016

২৬. হরষে-বিষাদে

দিন যতই যাচ্ছিলো আর দূর দিগন্তে দুর্যোগের কালো মেঘ চিরে বিজয়ের সূর্য্য ধীরে ধীরে যতই উপরে উঠছিলো, আনন্দের সাথে সাথে এক ধরণের বিষাদও  দেখা দিচ্ছিলো বড়দের কথায় বার্তায়।  সেটা শীঘ্রই  বাড়ী  ফেরার আনন্দ   আর নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবার বিষাদ।  আমরা যখন বাড়ি থেকে পালাই, গ্রামে আমাদের বন্ধু বা শুভানুধ্যায়ী ছিল প্রচুর।  আমার জানামতে গ্রামের কারো সাথে আমাদের কোনো ব্যাপারে বাকবিতন্ডা ছিল না।  অধিকাংশ লোকই কোনো না কোনো ভাবে আমাদের বাড়ীর  সাথে জড়িত ছিল।  কেউ ছিল আমাদের খদ্দের, কেউ বা আমাদের বাড়ীতে  কাজ করতো।  এখনো দেশে গেলে সবার সাথে দেখা করার চেষ্টা করি, তারা শ্রদ্ধা ভরে  বাবা-কাকাকে স্মরণ করে, তাদের জীবনে আমাদের বাড়ীর  অবদানের কথা মনে করে।  কিন্তু যুদ্ধের ওই দিনগুলোতে অনেকেই আমাদের বাড়ীঘর  লুট করেছিল, শুধু আমাদের কেন, সমস্ত হিন্দু বাড়ীই  ভূমিষ্যাৎ করে ফেলেছিলো।  না, এরা দেশদ্রোহী ছিল না, রাজাকাররা যেভাবে মানুষ মেরেছে, এরা  সেটা করেনি।  তারপরেও সবারই একই প্রশ্ন -
- শেষ পর্যন্ত তুমিও একটা করতে পারলে ?
এটা সেই জুলিয়াস সিজারের অমর বাক্যের মতো - "ব্রুটাস, শেষ পর্যন্ত তুমিও?"
এটাই মনে হয় মানুষের স্বভাব, বিশেষ করে অভাবী মানুষের।  এই লোকগুলো কোনো দিনই খারাপ ছিল না, কাজ করে জীবন যাপন করতো।  সৎ, বিশ্বস্ত। কিন্তু হঠাৎ যখন সুযোগ এলো, কেউই ভাবলো না, এটাতো প্রতিবেশীর বাড়ী, এটাতো প্রতিবেশীর জিনিষ - সেই প্রতিবেশী যার সাথে প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো, সুখ-দুঃখের গল্প হতো।  কোথায় এদের জিনিষপত্র পাহারা দেবে, তা না করে সব লুট করে নিয়ে নিলো। হঠাৎ করেই সব নৈতিকতা, সব নিয়ম-কানুন জীবন থেকে মুছে গেলো।  বাঙ্গালীর  উপর পাক হানাদারদের চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধ একদিকে যেমন দেশপ্রেমের মহান আদর্শে উজ্জীবিত করলো লাখ লাখ তরুণকে, একই ভাবে জন্ম দিলো দেশদ্রোহী রাজাকারদের।  আর এই দুই মেরুর মধ্যে রয়ে গেল এক বিশাল জনতা, যারা এই সুযোগে সাধারণ নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে লুট করলো প্রতিবেশীদের ধনসম্পদ। কে জানে, আজ যে দেশে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের হিড়িক পরে গেছে তার বীজটা ওই একাত্তরেই রোপিত হয়েছিল কিনা?

একাত্তরের ওই দিনগুলোতে বাঙ্গালী  হিন্দুকে অনেকগুলো পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যুদ্ধের আগে চাপ আসতো  মূলতঃ  সরকারের পক্ষ থেকে।  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সাধারণ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন গণ আন্দোলনের সময় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সব বাঙ্গালীই ছিল যাত্রী একই তরণীর।   আমি নিজে দাঙ্গা  দেখিনি, তবে ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান দেখেছি।  দেখেছি তখন কিভাবে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে।  একাত্তরে পালানোর আগেও সবাই মিলে  ঢাকা থেকে  বানের  জলের মতো ভেসে আসা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যখনই পাক সরকার অন্ততঃ  গ্রামাঞ্চলে এই যুদ্ধকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী রূপ দিতে সক্ষম হলো, তখন হিন্দুরা যেন অভিমূন্যের মতো চক্রব্যূহে আটকা  পরে গেলো।  আজ তার শত্রু শুধু হানাদার পাক বাহিনী নয়, তার পাশের বাড়ীর  লোকটাও।  এরা  পরের মাঝে পরতো সারা জীবনই  ছিল, এখন তারা আপনের  মাঝেও পর হয়ে গেলো।  দেশে আজ পরেরা  চলে গেছে, কিন্তু আপনেরা  এখনো এদের আপন করে নিতে পারে নি, তাইতো এখনো তারা আপনের  মাঝেও পর  হয়ে রয়ে গেছে।

যুদ্ধ পরবর্তী গ্রামের কথায় আমরা পরে আসবো, তবে আগ  বাড়িয়ে শুধু এটুকুই বলতে পারি, প্রথমে একটু দ্বিধা দেখা দিলেও সবার সাথে আবার আগের মতোই সম্পর্ক গড়ে উঠে।  শুধুমাত্র জ্যাঠামশায় আর তার ঘনিষ্ট বন্ধু জলিল চাচা (জলিল মেম্বার) আর কখনো কথা বলেনি।  এখন মনে হয় অযথাই তারা নিজেদের মতভেদগুলি দূর করেনি।  তবে তখন খুব ছোট ছিলাম, অনেক কিছুই আজকের মতো করে বুঝতাম না।  জীবনের অনেক চড়াই  উৎরাই পেরিয়ে অনেক কিছু নতুন করে বুঝতে শিখেছি, নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি।  না না, এটা কোনো মনস্তাত্বিক ব্যাপার নয়, তবুও মনে হয় আমি নিজের অজান্তেই সে কাজটা করি।

ছবি তুলি বলে অনেকেই  আমার কাছে আসে।  দেখি ওরা  যতটা না ছবি তুলতে আসে, তার চেয়ে বেশী  কথা বলতে।  মনে হয়, যেহেতু আমি বিদেশী আর লোকজনের সাথে কম মিশি আমি কথা ফাঁস করবো এ ভয় না পেয়ে আমাকে ওদের কথা বলে যায়।  অনেকটা সমাধি ক্ষেত্রে কথা বলার মতো। এদেশে মানুষ নিজেদের মনের কথা বলার জন্য প্রিয়জনদের সমাধিতে যায়, কেননা সমাধি গোপনীয়তা রাখতে পারে।  আমিও অনেকটা তাই।  আর ভালো পোর্ট্রেটের জন্য দরকার রিল্যাক্স  মুড্। আমি নিজেই ওদের উৎসাহিত করি এজন্যে।  আর মানুষ রিল্যাক্স ফিল করে যদি যার সাথে বসে আছে তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে।  অনেকেই বলে তাদের সমস্যার কথা, তাদের ভালোলাগা বা মন্দলাগার মানুষদের কথা।  অনেকটা টু ইন ওয়ান - ছবি তুলাও হলো আবার নিজের কথাগুলো বলে মনকে হালকা করাও  গেলো।   আমি প্রায়ই ওদের একটা গল্প শোনাই, যেটা নিজে সব সময় মেনে চলি।  এ গল্পটা আমাকে বলেছিলো আমার ক্লাসমেট কাম  রুমের শ্রীকুমার।  প্রচন্ড ভালো মানুষ ছিল ও, আর তাই হয়তো নিজের পড়াশুনাটা ঠিক মতো  শেষ করতে পারেনি।  যদিও এক রুমে থাকতাম ওর সাথে আমার কথা হতো কালে ভদ্রে।  সকালে আমি আর ইয়েভগেনি যখন ক্লাসে চলে যেতাম ও ঘুমুতো, আর রাতে ও যখন ফিরত আমরা ঘুমোতাম। তারপরেও মাঝেমধ্যে  দেখা হয়ে গেলে গল্প করতাম, বেড়াতে যেতাম।  প্রায়ই যেতাম রাতের আরবাতে, যেখানে হিপ্পিরা গিটার বাজিয়ে গান করতো আর পুলিশ এসে আমাদের চলে যেতে বলতো। দূরে গিয়ে দাঁড়াতাম, কিন্তু পুলিশ পিছু ছাড়তো  না। কখনো কখনো যেতাম চার্চে, বৃদ্ধা মহিলারা আমাদের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাতো।  কুমার চেষ্টা করতো ক্রস আঁকতে , আমি সেটাও করতাম না।  এই কুমার একদিন আমাকে একটি গল্প বলে।  ও বলেছিলো সার্ত্রে র কোনো এক লেখায় পড়েছিল, কিন্তু আমি সার্ত্রে র প্রায় সব লেখা পরেও এটা উদ্ধার করতে পারিনি।

অনেক দিন আগে প্যারিসে  জন আর পল নাম দুই বন্ধু বাস করতো।  জন খুব নামকরা শিল্পী আর পল বিশ্ববিখ্যাত লেখক।  উভয়েই অনেক আগেই জীবনের  মধ্যাহ্ন পেরিয়ে  বার্দ্ধক্য  ছুঁই ছুঁই করছে।  বিকেলে যেহেতু করার কিছুই থাকে না, দুজনেই এসে বসে এক বিখ্যাত ক্যাফেতে - গল্পে গল্পে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত  নামে  প্যারিসের আকাশে।  এভাবেই সুখ-দুঃখে কাটে তাদের দিন।  একদিন জনের অন্য এক বিশ্বস্ত বন্ধু  জনকে বলে
- তুমি কি জানো  যে পল হোমোসেক্সুয়ালিস্ট?
- হতেই পারে না।
অনেকটা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে জন। তারপর ভাবতে থাকে, আচ্ছা এই বন্ধুর তো পলের নামে মিছিমিছি মিথ্যে বলার কথা ছিল না।  ব্যাপারটা কি? তাই সে  এক গোয়েন্দার শরণ  নেয়।  কয়েকদিন পরে গোয়েন্দা প্রমান নিয়ে আসে যে পল সত্যি সত্যি হোমোসেক্সুয়ালিস্ট। খুব আপসেট  হয় জন।  বিকেলে পলকে সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, পল শুধু মাথা নাড়িয়ে বলে
- তুমি যা জেনেছো ভুল জেনেছো।
এর পর থেকে তাদের বন্ধুত্বের ইতি ঘটে।  কেউই আর এই ক্যাফেতে আসে না, দেখা করে না, খোঁজ খবর নেয় না।  এভাবেই কাটে মাসের পর মাস। হঠাৎ একদিন প্যারিসের এক রাস্তায় দেখা হয় দুজনের।  পল জনের কাছে এসে বলে
- দুটো কথা বলি, শোন।  এই দেখো, আমি নামকরা লেখক।  আমার বৌ আছে, ছেলেমেয়ে আছে।  প্রতিদিন আমি ঘুম থেকে উঠে স্নান করি. চা খাই, বাজারে যাই, বাচ্চাদের সময় দেই, গল্প লিখি। সারা দিন এভাবে আমি হাজারো কাজ করি।  এই হাজার কাজের একটা আমার হোমোসেক্সুয়ালিটি।  এটা তো মানুষ খুন করা নয়, সমাজের ক্ষতি করা নয়।  তাহলে বলতো তোমার কাছে আমার সব পরিচয় ছাপিয়ে  এটাই বড় হলো কেন? আমার শত শত পরিচয়ের একটা এটা, আর তোমার কাছে এটাই আমার একমাত্র পরিচয় - এখানটাতেই আমার আপত্তি।

এই গল্পটা একেক জন একেক  নিতে পারে, তবে আমার জন্য মনে হয় প্রতিটি মানুষকেই, প্রতিটি ঘটনাকেই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হয়, বিভিন্ন এঙ্গেল  থেকে দেখতে হয়।  তা না হলে অনেকটা অন্ধদের হাতি দর্শনের মতো হয়ে যাবে - কেউ লেজ ধরবে, কেউ কান, কেউবা শুঁড়  আবার কেউবা পা - এভাবেই একটা আংশিক ধারণা  নিয়ে পুরা ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করবে।

তবে স্বাভাবিক অবস্থায় এসব মনে রাখলেও জরুরী  অবস্থায় আমরা এসব ভুলে যাই।  যার ফলে সারা জীবন হাতে হাত রেখে চলার পরও  আমরা কালকের বন্ধুরাই আজ ধর্ম, বর্ণ বা রাজনীতির নামে একে অন্যকে  খুন করতে পর্যন্ত পিছপা হই  না।  উল্টোটাও ঘটে।  গল্পটা আমার দিদির মুখে শোনা।  ২০০১ এ যখন দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তুঙ্গে, মৌলবাদীরা যখন মিছিল করে আমাদের গ্রামের দিকে আসছিলো হিন্দুদের আক্রমণ করতে, ওই মিছিল থেকেই এক ছেলে দৌড়ে আসে আমাদের বাড়ী।  ও ছিল সুধীরদার ছাত্র, এসেছে স্যারকে সাবধান করে দিতে।  আর পাশের বাড়ীর  মজনু ভাই এসে নিয়ে গেছে সবাইকে নিজের বাড়ীতে।  ভালো মন্দ এসব  নিয়েই  জীবন।

এক সময়ে রাশিয়াতেও বিদেশীদের  উপর আক্রমণ হতো।  আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুরা তাই আমাকে একা যেতে দিতো না কোথাও, ওদের সাথেই গিয়ে ছবি তুলতাম।  কয়েকদিন আগে নদীর ওপরে ক্লাবে গেছি।  সাধারণত বন্ধুদের কেউ নিয়ে যায় আবার গাড়িতে করে বাড়ী  পৌঁছে দেয়।  ওই দিন একাই  গেছি।  অনেক দিন এসব ঘটে না, তাই কোন চিন্তা ছিল না।  রাত  ১১ টার  দিকে যখন বেরুবো, স্লাভা বললো, চল তোকে এগিয়ে দেই।  যদিও কথা ছিল ও আরো কাজ করবে।  কথা বলতে বলতে বাসস্ট্যান্ডে এলাম।  বাস আসে না।  কথাও ফুরিয়ে গেছে।  কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, ও একথা ওকথা বলে সময় নষ্ট করছে।  বাস এলে আমি উঠে বসলাম, ও চলে গেলো।  পরে আমি বুঝলাম, আসলে আমি যাতে ঝামেলায় না পড়ি তাই ও ইচ্ছে করেই কথা বলে বলে আমার সাথে ছিল।  আসলে প্রতিদিন কত লোক যে আমাদের   "হাই" বলে, হেসে স্বাগত জানায় - কয়টা মুখ আমরা মনে রাখি? অথচ কেউ একটু গালমন্দ করলে দিনের পর দিন ওই মুখটা ভাসে চোখের সামনে।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম।  একটা সাদা কাগজে এক ফোঁটা  কালো দাগ।  শিক্ষক প্রশ্ন করেছে, কি দেখছে ছাত্ররা। সবাই ওই কোলো দাগ নিয়েই লিখছে।  যেন সাদার কোনো অস্তিত্বই নেই। শিক্ষক পরে বলছে, আমরাও জীবনে কালো অংশ গুলোই দেখি, কষ্ট গুলোই মনে রাখি।  আমার মনে হয় এটা সন্দেহজনক  সিদ্ধান্ত।  আমি নিশ্চিত যদি কালো ক্যানভাসে একফোঁটা সাদা দাগ থাকতো, ছাত্ররা ওই সাদা দাগ নিয়েই লিখতো। মানুষ বা চোখ সব সময় কন্ট্রাস্ট খুঁজে।  প্রশান্ত পুকুরের জলে এক টুকরো  পাথর ছুঁড়ে  দিলে যে ঢেউ তৈরী হয় ওটাই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাকি পুকুরটা আমাদের নজরে আসে না। একই ভাবে চারিদিকে যখন অনেক ভালোর   মধ্যে হঠাৎ মন্দ কিছু দেখি তা আমাদের চোখে পরে বেশী, যেমনটা চোখে পরে ছোট্ট একটা ভালো কাজ অনেক মন্দের মধ্যে।  তাই মনে হয় একাত্তরের আগে আগে এই ভালোটা, মানে সাম্প্রদায়িক সংহতি অনেক বেশি ছিল, তাই ওই লুটের ঘটনা খুব বেশী  করে চোখে পড়ছিলো, আর আজ চারিকে যখন অনিশ্চয়তা বাড়ছে ওই ছেলেটার মিছিল থেকে দৌড়ে এসে দাদাকে সাবধান করার ঘটনাটা সমানে চলে আসে, যেমনটা কয়েকদিন আগে মৌলবাদীদের দ্বারা নাসিরনগর আক্রমণের  সময় কিছু মুসলিম যুবকদের সংখ্যালঘুদের রক্ষার ঘটনা সবার দৃষ্টি কেড়েছে।  কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? অনেক সময় মনে হয় এই ২০১৬ তেও আমরা আবার সেই একাত্তরের দিনগুলোর মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি।
 

দুবনা, ২৪ নভেম্বর ২০১৬





Wednesday, November 23, 2016

২৫. সোনার হরিণ

আজ একাত্তর থেকে অনেক দূরে দুবনা  নাম রাশিয়ার এক ছোট্ট শহরে বসে সেসব দিনের কথা খুব সহজেই লিখে যাচ্ছি।  কিন্তু ওই দিনগুলোতে, যখন চারিদিকে হায়েনার ডাক, মৃত্যুর পদধ্বনি যখন মাটিতে কান পাতলেই শোনা যায় - এই রাশিয়া, এই দুবনা  সবই ছিল অলীক কল্পনা।  এসব দিনগুলোতে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনোই উপায় ছিল না। কিন্তু কিসের অপেক্ষা? স্বাধীন দেশ নাকি আবার সেই পাকিস্তান? যুদ্ধের আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্র এ দেশে হিন্দুদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিল।  যদিও দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পরেই  জিন্নাহ বলেছিলো পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে, বাস্তবে সেটা কখনোই কার্যকরী হয়নি।  দাঙ্গা কবলিত ভারত ভাগ হলে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটো রাষ্ট্র এই সব তিক্ততা পেছনে ফেলে রেখে সব চেয়ে বন্ধুবৎসল দুটো রাষ্ট্রে পরিণত হবে, জিন্নাহর এই আশাটাও দূরাশাই  থেকে গেছে।  তাই আমাদের, মানে হিন্দুদের জন্য শুধু একটাই পথ খোলা ছিল - এ যুদ্ধে জিততে হবে।  এই আশা নিয়েই আমরা বেঁচে থাকতাম, রেডিওতে কান পেতে শুনতাম আকাশবাণীর খবর, শুনতাম চরমপত্র  আর আশায় বুক বাধতাম।

আকাশবাণী থেকেই জানতে পেতাম ইন্দিরা  গান্ধীর তৎপরতা। আর অপেক্ষায় থাকতাম, কবে ভারতীয় সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে।  ওই সময়ে আমেরিকার বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর খবরও  আমাদের কানে আসে আর কানে আসে সোভিয়েত  ইউনিয়নের ভারত আর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোর।  যুদ্ধের  ঠিক আগে আগেই আমেরিকার ভ্যানেল কোম্পানি কালিগঙ্গার উপর সড়ক সেতু নির্মাণ শুরু করে, ফলে আমেরিকান সাহেবদের  আমাদের গ্রামে যাতায়াত অনেকটা ডালভাত মতো হয়ে যায়, তারপরেও এই খবর আমেরিকার প্রতি আমার মধ্যে  ঠিক ঘৃণা না হলেও এক ধরণের বীতশ্রদ্ধার জন্ম দেয়, যেটা মনে হয় এতো বছর পরেও রয়ে গেছে।  যদি ভুল না করি যুদ্ধের আগে আগেই বাবা কল্যাণদাকে  একটা গ্লোব কিনে দেয়। সেখানে ভারত  আর চীনের উপরে বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে ছিল সবুজ রঙের সোভিয়েত দেশ।  তখন থেকেই  আমার ওই দেশের প্রেমে পরে যাওয়া।  আর যখন শুনলাম এই সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করছে, তখন তো আর কথাই  নেই।  আমার পরবর্তীতে এ দেশে আসার পেছনে এই ঘটনা ডিসিসিভ রোল প্লে করে।

যদিও দেশ ভাগ হয় আমার জন্মের ১৭ বছর আগে, তবে আমাদের জন্য এটা ছিল বিশাল বিপর্যয়ের মতো। বাবা-মা তো বটেই কয়েকজন দাদা-দিদিরাও এই ঘটনার সাক্ষী।  এতো দিন হয়ে গেলেও দেশভাগের ক্ষত তখনও  দগদগ  করছিলো এদের বুকে।  যেহেতু কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার রাজধানী, অনেকেই কলকাতায় পড়াশুনা করতো, ওখানেই থাকতো।  তাই দেশভাগের পর কেউ কেউ ফিরে এলেও অনেকেই রয়ে যায় কলকাতায়।  দেশের সাথে সাথে ভাগ হয়ে যায় পরিবার। তখন অনেক দাদু-দিদিমা, মামা-মাসী, দাদা-দিদি অনেকেই শুধু কাগুজে হয়ে যায়, গল্পের হয়ে যায় - যাদের কথা বাড়িতে অনবরতই  হচ্ছে, কিছুদিন আগেও যারা পূজার ছুটিতে বা বিয়ে-অন্নপ্রাশনে দল বেঁধে বেড়াতে আসতো  বাড়ীতে, আজ তারা কলমের এক খোঁচায় ভিন দেশী  হয়ে গেছে।  শুধু তাই নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্র শত্রু-সম্পত্তি আইন করে যারা গেছে তো গেছেই, কিন্তু যারা রয়ে গেছে তাদের এ দেশে থাকাটাকেও ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে।  তাই আমাদের মতো পরিবার মুক্তিযুদ্ধে  ভারতের সাহায্যের  অপেক্ষা করবে এটাই স্বাভাবিক।

জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়ই ......

অথবা

শোনো একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ্ মুজিবরের কণ্ঠ স্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি  
আকাশে বাতাসে উঠে রনি .....

যুদ্ধকালীন সময়ের আরো কত গান যে মনে গেথে আছে।  এই সময়ে বাঙালী  শুধু যুদ্ধই করেনি, দেশাত্মবোধক বাংলা গানেও এক বিপ্লব ঘটিয়েছে।  যদি ভুল  না করি, এই সময়েই আমরা শ্লোগান দিতে শুরু করি

জয় বাংলা জয় হিন্দ
ইন্দিরা মুজিব কোসিগিন

যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে, যখন ঢাকা থেকে হাজার হাজার লোক পালাচ্ছিল আর এর পরে যখন আমরা নিজেরাও বাড়ী  ছেড়ে পালিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল অস্ত্রহীন, প্রশিক্ষণহীন বাঙ্গালী  এই যুদ্ধে বেশী  দিন  টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু প্রতিটি ছোট ছোট বিজয়, প্রতিটি পেরিয়ে আসা দিন সবার মনে বিশ্বাস জাগাচ্ছিল যে বাঙালী  সব বিপদকে উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারে, যুদ্ধে জিততে পারে।

মাগো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি   .........

হ্যা, মনে ভয় ছিল, শংকা ছিল, কিন্তু এতো ভয় আর এতো আশংকার মধ্যেও ছিল আশা, নতুন দিনের আশা, নতুন জীবনের আশা, নতুন দেশের আশা - যে দেশে শুধুমাত্র হিন্দু হবার জন্য কাউকে দেশত্যাগ করতে হবে না, নিজদেশে পরবাসী হয়ে মাথা নীচু  করে বাঁচতে হবে না।  একটা সময় ছিল, যখন এই সোনার হরিণটা আমাদের কাছে ধরাও দিয়েছিলো।  কিন্তু নোংরা রাজনীতির দূষিত বায়ুতে টিকে  থাকতে না পেরে সেই স্বপ্নের হরিণটা দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে অজানার দেশে।

দুবনা,  ২৪ নভেম্বর ২০১৬  


২৪. আর পি সাহা

তালৈ মশাই  এলেন মনে হয় শীতের প্রারম্ভে।  আসলে যত কিছুই বলি, আমাদের দিনক্ষণ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত স্কুল-কলেজ বা পূজা-পার্বনের সাথে।  যুদ্ধের সময় যেহেতু দুটোই বন্ধ ছিল, তাই ঠিক কখন যে কোন ঘটনা ঘটেছিলো, হলপ করে বলতে পারবো না।  তবে এটুকু মনে আছে,  উনি এসেছিলেন পায়ে হেঁটে।  এমনিতে মির্জাপুর থেকে বৈলতলার দূরত্ব খুব  বেশি না, অন্ততঃ  এখন গুগল ম্যাপ খুললেই সেটা বুঝা যায়।  সেই সব দিনে  আমাদের বাড়ী  থেকে মির্জাপুর ছিল পুরো এক দিনের পথ, মানে অনেক দূর।  আমারা মামা  বাড়ী  যেতাম তিন তিনটে নদী  ফেরী  করে পার হয়ে, ঢাকা ঘুরে।  তাই তখন আমি বেশ অবাকই হয়েছিলাম এতো ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে তালৈ মশাই  আসায়।  এখন, যখন রাস্তা-ঘাট  অনেক উন্নত হয়েছে, ভেতর দিয়ে অনেক রাস্তা হয়ে গেছে, আমার বাড়ী  থেকে মির্জাপুরের দূরত্ব বারো ঘন্টা থেকে নেমে মাত্র ঘন্টা  দুই-আড়াইতে  দাঁড়িয়েছে, এটাকে তেমন দূরত্বই মনে হয় না।  তালৈ মশাই যে সে পথেই এসেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যাই হোক, প্রথমে তাদের নিজেদের আর মামাদের খবরাখবর নেবার পর সবাই জানতে চাইলো আর পি সাহার কথা।  আমার মনে নেই ওনার মৃত্যু সংবাদ আমরা আগে জানতাম কি না? জানতাম যে উনি মির্জাপুরেই ছিলেন, আর পাক আর্মিরা তার ওখানে ক্যাম্প করেছিল।  এটাকে কেউ কেউ পাকিস্তানী শাসকদের সাথে আর পি সাহার উঠাবসার পুরস্কার  মনে করলেও আসলে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।  

 রণদা সাহা আমাদের  পরিচিত ছিলেন, তাছাড়া বৌদিদের বাড়ী  ছিল তাদের বাড়ীর  পাশেই। ছোট বেলায় অনেক বার গেছি তার সেই বিখ্যাত কুঁড়েঘরে, মায়ের সাথে।    সব মিলিয়ে খুব আপন ছিলেন তিনি। অনেক গল্প শুনেছি তাকে নিয়ে।  লবণের ব্যবসা করে এক সাধারণ পরিবার থেকে এতো উপরে উঠে আসেন।  আর শুধু নিজেই ধন উপার্জন করেন নি, দুহাতে তা বিলিয়ে গেছেন মানুষের মাঝে।  বাংলাদেশে প্রচুর স্কুল-কলেজ আছে যা ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় করা।  কেউ জায়গা দিয়েছে, কেউবা স্কুলঘর বা কলেজ তৈরী করে দিয়েছে।  আর পি সাহা মনে হয় হাতে গোনা কিছু লোকের একজন যিনি জমিদার ছিলেন না।  তার তৈরী কুমুদিনী হাসপাতালের নাম জানতো না এমন লোক তখন পাওয়া কষ্ট। এটা শুধু হাসপাতালে নয়, স্কুল, কলেজ আরো কত কি? মির্জাপুরের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল।  মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে আমি নিজেই পড়াশুনা করেছি।  যদিও স্কুলের পাঠ্য বইতে আমরা দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীনের  গল্প পড়েছি,  দান কর্মের দিক দিয়ে রণদা সাহাও কম করেন নি কোনো মতেই। এই প্রাচুর্যের জন্যই হোক বা দানকর্মের জন্যই হোক উনি মানুষের মাঝে রণদা সাহেব নামেই পরিচিত ছিলেন।     দেশভাগের পর যখন একের পর এক হিন্দু জমিদাররা দেশত্যাগ করেছে, তখন উনি দেশ ছাড়ার  চিন্তা করা তো দূরের কথা, দুহাতে নিজের ব্যবসাকে প্রসস্থ করেছেন, আর দেশ ও দেশের মানুষের জন্য একের পর এক হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসব গড়ে গেছেন।   তাই পাক সেনারা যে তাকে হত্যা করবে, এটা ছিল অনেকটা ধারণার অতীত। তবে আমরা ধারণা করি মানুষদের ব্যবহার নিয়ে, অমানুষদের ব্যবহার  নিয়ে তো আর করতে পারি না।

আর পি সাহার হত্যার খবর তাই ছিল খুবই পীড়াদায়ক।  হত্যা করা হয়েছিল শুধু তাকেই নয়, তার একমাত্র ছেলে রবিদা কেউ।  আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে ছেলেকেই একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করা হয়, তাই দুই মেয়ে জীবিত  থাকার পরও  আর পি সাহার এই বিশাল সাম্রাজ্যের কি হবে তা নিয়েও কথা বলছিলো বাবা-কাকারা।  যুদ্ধ চলছে, অনবরত লোকজন মারা যাচ্ছে, তবে অধিকাংশই সাধারণ মানুষ, সমাজের উঁচু পর্যায়ের ঠিক কেউ নন।  অন্ততঃ  আমরা তখন জানতাম না।  বুদ্ধজীবীরা তখন সবাই বেঁচে আছেন।  তাই এই খবর ছিল অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। যুদ্ধের প্রথম দিকে পাকবাহিনী এলোপাতাড়ি সবাইকে হত্যা করে সন্ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশে।  কিন্তু এর পরেও মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিবাদ করে, হাতে তুলে নেয় অস্ত্র, পাকিস্তান চায় এই মুক্তিযুদ্ধকে এক সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে।  গ্রাম এলাকায় বেছে বেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করা হয়।  শুনেছি , বয়স্ক পুরুষ মানুষ দেখলেই ওরা  প্রথমে পরীক্ষা করতো ওই লোকের মুসলমানী  করা হয়েছে কিনা? অনেক জায়গায় জীবনের ভয়ে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়।  আমাদের গ্রামে ভাষান  ঠাকুর আর তার ছেলে  অধীর ঠাকুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।  যুদ্ধের পরে যদিও তারা আবার স্বধর্মে ফিরে আসে, অনেক পরে অধীরদা আবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় আর গোলাম রসূল নাম নিয়ে পীরের মর্যাদায় দিন কাটায়। অধীরদা  বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত আমাদের গ্রামেই ফিরে আসে।  সমাজের উচ্চ পর্যায়ের বহু লোক তার অনুসারী হয়।  আমাদের সাথে অবশ্য সব সময়ই তার ভাল সম্পর্ক ছিল, আমি দেশে গেলে দেখা হতো।  আমাদের কাছে সে  কখনো গোলাম রসূল ছিল না, আমাদের অধীরদাই ছিল।

তালৈ মশাই দিন দুয়েক থেকে চলে যান নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে।  পেছনে রেখে যান এক রাশ বেদনা, প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তা।

এখনো দেশে গেলে মির্জাপুর যাই মামা বাড়ী, ঘুরে আসি আর পি সাহার বাড়ী।  সেই কুঁড়েঘর এখনো আগের মতোই আছে।  বাড়ী  জুড়ে নাট মন্দির আর সেই বিখ্যাত পানসি নৌকা এখন তোলা আছে বাড়ির এক কোনে।


দুবনা, ২৩ নভেম্বর ২০১৬  



Tuesday, November 22, 2016

২৩. মাছ

বইরাগীর চকের  জল যতই কমছিল, বাড়ির সামনের খালে মাছ ততই বাড়ছিল।  আমরা বলতাম, বর্ষায় মাছেরা  ভয়ে ধান ক্ষেতে পালিয়েছিলো, এখন জল নামতে শুরু করায়  ওরা  নদীতে ফিরে যাচ্ছে।  এটা আমাদের পাক বাহিনীর তাড়া  খেয়ে বাড়ী  ছেড়ে পালানোর মতো আর কি। ওগুলো অবশ্য একেবারেই বাজে কথা, তবে ওই বয়সে এসব শুধু বলতামই না, যাকে  বলছি তাকে বিশ্বাস করানোর জন্য আরো অনেক কিছুই করতাম।  মনে আছে, হারুকে একবার বলেছিলাম, ছোট বেলায় একদিন আমার পা কেটে যায়, কিন্তু বন্ধুরা খুব করে ফুটবল খেলতে ডাকছিলো, তাই কাটা পা টা  বাড়িতে রেখেই ফুটবল খেলে আসি, এমন কি গোলও  করি। ইস,  সেই কল্পনাগুলো যদি এখন থাকতো, কত যে রোমহর্ষক গল্প লিখতে পারতাম!
ওই দিনগুলোতে খালে মনে হয় জাল ছাড়া আর কিছুই ছিল না।  জেলেরা বেড়ি জাল ফেলতো পুরো খাল  জুড়ে।  উপরে ভাসতো শুধু   কাঠিগুলো, কাঠের তৈরী এক ধরণের সিলিন্ডার, যা সাধারণতঃ  ডুবে না। অনেকটা জলহস্তী যেমন নাকটা বের করে সারা শরীর জলের নীচে  লুকিয়ে রাখে এই জালগুলোও  তেমনি থাকতো সারা খাল জুড়ে, আর ভেসে থাকা সিলিন্ডারগুলো জানান দিতো ওদের অস্তিত্ব। পরের দিন সকালে জেলেরা কয়েকটি নৌকা করে গিয়ে প্রথমে ওই সিলিন্ডারগুলো এক জায়গায় জড়ো  করতো অনেকটা বস্তার মুখ বাধার মতো, তারপর শুরু হতো জাল টেনে  তোলা।  আমরা তীরে দাঁড়িয়ে দেখতাম  রুপালি মাছগুলো কিভাবে জালে পরে ছটফট করছে।  ছোট বড় কত ধরণের মাছ।  আর জালের ছিদ্রগুলো এতো ছোট ছিল, মনে হতো ওটা গলে মাছতো দূরের কথা জলও বেরুতে পারবে না।  এখানে, রাশিয়ায়, জালের ছিদ্রের ন্যূনতম সাইজ আছে, যাতে ছোট মাছ বেরিয়ে যেতে পারে, আমাদের দেশে তখন সেটা ছিল না, এখনো আছে কিনা জানি না। যদি বেড়ি জাল তোলা হতো  সকালে, ভেসাল  কাজ করতো সারা দিন।  ভেসালগুলো ছিল কুমের ওখানে।  ভেসাল নামিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতো জেলে, তারপর ধীরে ধীরে তুলতো উপরে।  অনেক সময় আমরাও যেতাম নৌকা নিয়ে।  জেলেরা যেহেতু পাশের বাড়ীর, তাই খুব করে চাইলে ভেসাল তুলতে দিতো। এতো মাছ জীবনে আর কখনো দেখিনি।  যীশু খ্রিস্ট পিটারের জালে যেমন মাছ তুলে দিয়েছিলেন, যুদ্ধও যেন তেমনি  জেলেদের জালে মাছের পাহাড় তুলে দিয়েছিলো।  আমরা বলতাম, নদীতে ভেসে যাওয়া লাশ খেয়ে খেয়ে মাছের পরিমান এমন বেড়ে গেছে।

কত যে রকমারী  মাছ ছিল!  রুই, কাতলা, বোয়াল তেমন ছিল না, প্রচুর পরিমান ছিল কালিবাউশ, সরপুঁটি, টাটকিনি এইজাতীয় মাছ। আমি যেহেতু মাছ তেমন খেতাম না, তাই মাছের লাফালাফি দেখেই খুশী  থাকতাম।  আমার মেন্যুতে  ছিল হাতে গোনা কয়েকটা মাছ - চিতল,  রুই, কৈ, কাজলী, বাতাসী  আর মলা।পাবদা যদি বোয়ালের  ছোট সংস্করণ হয়,  কাজলী ছিল  তার ঠিক পরেরটা। ওই সময়ে আর স্বাধীনতার পরে কাজলী মাছের সুক্ত ঝোল ছিল আমার খুব প্রিয়, বিশেষ করে মায়ের রান্না।  তবে চিতল ছিল সবার উপরে। তাই যদি চিতল মাছ ধরা পড়তো, ওটা আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেত।  যুদ্ধের পরেও এলাকার জেলেদের বলা থাকতো, যেন চিতল মাছ ধরা পড়লে আমাদের বাড়ী  দিয়ে যায়।  এই রেয়াজ আমি এখানে আসার আগে পর্যন্ত চালু ছিল।  কৈ  মাছ পেলে অনেকগুলো কিনে রাখতো, কেননা জিওল আর মাগুর বাদে ওটাই একমাত্র মাছ যা অনেক দিন  জিইয়ে রাখা যায়।  একটা মাটির কলসে  জল ভরে ওতে মাছ ছেড়ে দিতো, ওরা  ওখানেই আনন্দে দিন কাটাতো। আমরা বলতাম, কৈ মাছ শুধু জেলেকেই নয়, এমনকি যে মাছ কুটছে (কাটছে) আর রান্না করছে তাদেরকেও দেখে, দেখেনা  শুধু  তাকে, যে ওকে খাচ্ছে।  কেননা মাছ কাটার সময় ওর কি নাচন-কুন্দন, ছাই  দিয়ে খুব ভালো করে মেখে ধরে রাখতে হতো, কৈ  মাছ কাটতে গিয়ে মা-খুড়িমারা হাত পর্যন্ত কেটে ফেলতো।  এমন কি কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে  ছাড়ার  পরও  ও লাফাতো।  আমরা এক অন্যেকে বলতাম, পাপ করলে যমরাজ তোকেও এভাবে তেলে  ভাজবে, আর তুইও এমনি করেই লাফাবি। হ্যা, ওই সময় কত কিছুই যে ভয় করতাম!

আরেকটা প্রিয় মাছ ছিল বাতাসী।  ছোট ছোট এই মাছের চর্চরি ছিল খুব প্রিয়। বাবা আর জ্যাঠামশায় নিরামিষাশী। বাবা কিছু না বললেও জ্যাঠামশায় বাড়ীতে মাংস উঠতে দিতো না।  বাড়িতে থাকাকালীন রাখালদের ওখানে বা কাচারী ঘরে মাংস রাঁধতে পারলেও এখানে সে ব্যবস্থা ছিল না, তাই খাবার-দাবারে আমার বাছবিচার খুব একটা কাজে আসেনি, অন্ততঃ  যুদ্ধাবস্থায়।  এখন আর সেই রামও  নাই, সেই রাবণও নাই।  সব খাই যা পাই। ২০১১ সালে প্রায় ১৪ বছর পরে যখন বাড়ী  গেলাম, প্রায়ই দেখি বড় বড় মাছ খেতে দিচ্ছে। আমার ছোট বেলায় বড় মাছ খুব দামী  ছিল, সবাই কিনতে পারতো না। ভাবলাম, আমি এলাম বলে ওরা  এই সব বড় মাছ আনছে। তাই একদিন দিদিকে বললাম
- দিদি, আমি এখন সব খাই।  অযথা তোদের  কষ্ট  করে বড় মাছ আনতে  হবে না।
- নারে ভাই, এখন ছোট মাছ পাওয়াই  যায় না। বড় মাছের চাষ হয়, দাম তাই কম।  এখন আমরা এমনিতেই এসব মাছ খাই।
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আর বেচারা মাছেরা স্বাধীনতা হারিয়েছে।  এখন ওরা  গরু-ভেড়া, হাঁস-মুরগীর  মতোই অনেকটা গৃহপালিত জীব হয়ে গেছে।  অবশ্য আমরা নিজেরাই বা কতটুকু স্বাধীন, এটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।  

স্বাধীনতা কি শুধুই একটা ডকট্রিন? মনে হয় যখন থেকে মানুষ বুঝতে শুরু করে তখন থেকেই শুরু হয় তার পরাধীনতা।  এর আগে যে ছিল না তা নয়, তবে তখন সে সেটা বুঝতো না।  অন্ততঃ  আমি সেটাই মনে করি।  পরাধীনতা না বলে বলা উচিত পরনির্ভরতা। কারণ    অনেক কিছুই কেউ তাকে করতে বাধ্য করে না, তবে বাঁচার জন্য, সামনে এগুনোর জন্য এগুলো সে নিজেই গ্রহণ করে।  আমরা যত বেশী  জ্ঞান অর্জন করি, অজানার সীমাটা ততই বেড়ে যায়।  নতুন কিছু জানা মানে, সামনে আরেকটা দ্বার খুলে যাওয়া।  আর ওই জানালা দিয়ে আমরা দেখি বিস্তীর্ন প্রান্তর যেখানে মেঘের পরে  যেমন  মেঘ জমে থাকে তেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজানার ভান্ডার।  ঠিক তেমনি করে আমরা যখন স্বধীনতার এক পর্যায়ে পৌঁছি, দেখি নতুন সম্ভাবনা, আর এই নতুনকে জানার, নতুনকে জয় করার স্বপ্ন আমাদের আবার পরাধীন করে। তবে সব সময়ই কি তা হয়? দস্যুরা মনে করে ওরা  যা খুশী  তাই করতে পারে, যাকে  খুশী  তাকেই খুন করতে পারে।  ওরা  কি স্বাধীন? না।  ওরা  পরাধীন ওদের অন্ধত্বের কাছে।  এই স্বাধীনতা আর পরাধীনতার সীমানা এত  সুক্ষ  যে অনেক সময় টের পাওয়া কষ্ট  সীমানার ঠিক কোন দিকটায় আমরা অবস্থান করছি।

এই রকম এক দিনে, যখন মাছে  মাছে   ভরে গেছে খাল, আমাদের ওখানে বেড়াতে এলেন বৌদির বাবা, আমাদের তালৈ মশায়।  যুদ্ধের সময় এই প্রথম কোনো আত্মীয় এলো আমাদের এখানে।  বৌদির  খবর নিতে এসেছে।  বড়রা অনেকক্ষণ  ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন খবর নিলো।  তারা কোথায় ছিল, কেমন ছিল এসব।  মির্জাপুর তালৈ মশাইরা ছাড়াও আমাদের বড় মামা থাকতো।  সবার খোঁজ খবর নেয়া হলো এক এক করে।  অনেকক্ষণ  ধরে জিজ্ঞেস করলো আর পি সাহার  কথা।

দুবনা, ২৩ নভেম্বর ২০১৬


Sunday, November 20, 2016

২২. নৌকাডুবী

যদি বাড়ীতে রাজাকার পড়ার আগের দিনগুলো ছিল প্রাণবন্ত, কর্মময়, পরের দিনগুলো হলো আবার অনিশ্চয়তায় ভরা। এখন আর আগের মতো হুটহাট কেরানীনগর বাজারে যাওয়া হতো না।  এক ধরণের ভীতি, যেতা ছিল যুদ্ধের প্রথম দিকে, আবার ফিরে এলো।  আর এসব কারণেই অনেক সময় বাজার-ঘাট ঠিক মতো করা হয়ে উঠতো না।  এর মধ্যেই চক থেকে জল নামতে শুরু করে, বাড়ীর  সাথে লাগানো পালানগুলো শুকিয়ে ওঠে।  ওখানে বিভিন্ন কচু গাছ জন্মাতো।  একদিন ওখান থেকেই কচুর ডগা আর কচুর লতি তুলে রান্না হলো। আমরা আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম অনিশ্চয়তার পথে। এর মধ্যে একটু একটু করে বইরাগীর  চোকেও  যেতে লাগলাম। ওখানে এখন কলমী শাকের ছড়াছড়ি - সেটাও তুলে নিয়ে আসতাম কখনো সখনো। যুদ্ধের অর্থাভাব শেষ পর্যন্ত আমাদেরও স্পর্শ করলো। কলমী শাক, নতুন ঘাস আর কচুরি পানা  সব আবার মনে করিয়ে দিলো গরু আনার কথা।  হারু-ছানাদের সাথে যখন ঘুরতাম মাঠে আর পানা  দিয়ে মাছ বানিয়ে খেলতাম, তখন ভাবতাম, এখন একটা গরু থাকলে মন্দ হতো না।  গরু পানা  খাবে আর আমরা খাবো  গরুর দুধ। প্র্যাগমাটিক চিন্তা-ভাবনা আর কি? তবে আমাদের এসব গল্প অনেকটা সিনেমার মতো মনে হতো, মানে পাঁচ-সাত-দশ মিনিটের গল্পেই গরুকে আমরা শুধু চড়াতামই না বইরাগীর চোকে, এরই মধ্যে গরুর বাচ্চা হতো, আর সেই বাছুরটা আমাদের পেছন পেছন ঘুরতো।  আমি তখন ওদের বলতাম কিভাবে আমরা গোরখের নাড়ুর অনুষ্ঠান করবো। 

বাড়ীতে  গরু বাচ্চা হবার পরে প্রথম তিন সপ্তাহ আমরা ওই গরুর দুধ খেতাম না।  এটাকে বলা হতো গ্যারা দুধ।  খুব ঘন নাকি হতো।  তখন ওই দুধের একমাত্র মালিক ছিল বাছুর।  অনেক সময় বাছুর না খেতে চাইলেও ওকে জোর করে খাওয়ানো হতো।  একুশ দিনের দিন গরুর দুধ দিয়ে ক্ষীর করা হতো আর তা দিয়ে মোটর দানার থেকে একটু বড় ছোট ছোট নাড়ু।  পাশের বাড়ির নিতাই মাঝি আসতো  সন্ধ্যার পর গোরখের নাড়ু দিতে।  হয়তো যে কেউই এটা করতে পারতো, তবে আমাদের বাড়ীতে  সব সময়ই নিতাই মাঝিই এই পূজার পুরুত হতো।  কোনো মন্ত্র ছিল না, শুধুই পাঁচালি পড়া।  রাশিয়ানরা যেমন চেসতুস্কা গায়, অনেকটা সে রকমই - কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই - নিতাই মাঝি একটা লাইন বলতো সুর করে আর আমরা তার পরে গলা ছড়িয়ে বলতাম হেইও বা হেচ্ছ - অনেকটা এই রকম 

- বলরে বলো 
- হেচ্ছ
- বাইচের নৌকা
- হেচ্ছ
- আগে বারো
- হেচ্ছ
- গাই বিয়ায়িল
- হেচ্ছ
- জোরছে বলো
- হেচ্ছ
- সাহা বাড়ী
- হেচ্ছ
- কালো গাই
- হেচ্ছ
- লাল বাছুর
- হেচ্ছ
...............

এভাবেই চলতো যতক্ষণ না নিতাই মাঝির গলা বসে যেত।  তারপর ছিল আসল কাজ।  বাগনাড়ু  খাওয়া।  আমাদের পাড়ায়  ওটা পারতো রত্না (রতন) আর  সুইস্যা (সুশীল) দুই ভাই। একটা কলাপাতায় সাতটা  নাড়ু রাখা হতো, আর জিমনাস্টদের মতো দুই  পায়ে দাঁড়িয়ে হাতদুটো মাথার উপর নিয়ে শরীরটাকে ধীরে ধীরে পেছন দিকে নামিয়ে আনতে হতো, এভাবে রত্না বা সুইস্যা চার পায়ে দাঁড়াতো, বুক থাকতো  আকাশের দিকে।  এরপর ধীরে ধীরে দুই হাত আর দুই পায়ে ভোর দিয়ে এগুতে হতো কলাপাতায় রাখা নাড়ুর ওখানে, আর ঘাড়  বাকিয়ে মুখ মাটিতে ঠেকিয়ে নাড়ু খেতে হতো।  এ সময় আমরা চাইলেই ওদের হাসাতে পারতাম, এটা ওটা বলতে পারতাম, যাতে ওরা নাড়ু খেতে না পারে। আর যতক্ষণ না ওই নাড়ু খাওয়া হচ্ছে, কেউই প্রসাদ পেত না। আর ওরা নাড়ু খাবার পরেই কেউ ঘটিতে করে ঠান্ডা জল ঢেলে দিতো ওদের গায়ে।  তাই গোরখের নাড়ু শীতকালে হলে  কাউকে সহজে রাজী করা যেত না গোরখের নাড়ু খেতে। আমাদের বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠানটা ছিল খুবই মজার, আর আমরাই ছিলাম এই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক। এর পর থেকেই গরুর দুধ সার্টিফিকেট পেত রান্না ঘরে ঢোকার।

গরুর সাথে যুক্ত আরেকটা অনুষ্ঠান ছিল পশুরা বা পুষুরা। এটা হতো শীতের শুরুতে, নবান্নের পর পর। নতুন ধানের চালের গুঁড়া করে তার সাথে জল মিশিয়ে এক দ্রবণ তৈরী করা হতো।  কখনও  রং ছাড়া, কখনো আবির মিশিয়ে রঙিন।  একটা গ্লাস ওই রঙে চুবিয়ে তা দিয়ে ছাপ  মেরে দিতাম গরুর গায়ে।  বাড়ির গরুগুলো ওই দিন নানা রঙে সেজে উঠতো। 
এভাবেই আমরা, হারু-ছানা  আর আমি গরু নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হতাম বর্ষা শেষ বইরাগীর  চকে ঘুরে ঘুরে।

হতে পারে আমরাই যুদ্ধের কোনো কুলকিনারা দেখতে পাচ্ছিলাম না, অথবা বড়দের কথায় এমন আভাষ  পেতাম।  এ ভাবেই আরো দীর্ঘ দিন বৈলতলায় কাটানোর এক সম্ভাবনা গড়ে উঠছিলো মনে মনে।  এলাকায় তেমন কিছু ঘটেছিলো না. মাঝে মঝ্যে এ গ্রাম পুড়ানো, ওখানে হামলার খবর আসছিলো, তবে সবই খুব ঢিলেঢালা।  এমনই  এক সকালে খবর এলো ধলেশ্বরীতে জেলেরা বেশ কিছু পাক সেনাকে ডুবিয়ে দিয়েছে।  ওই দিনই বেশ উত্তেজনা নিয়ে আমরা যাই কেরানীনগর বাজারে খবর শুনতে।  ওখানে গিয়ে জানলাম পুরা ঘটনা।

কেন যেন আমাদের বিশ্বাস ছিল পাঞ্জাবীরা  সাঁতার কাটতে জানে না। ওরা এমন কি নদীতে নাইতে ভয় পায়।  যাই হোক, আগের দিন সন্ধ্যায় এক দল পাঞ্জাবী সৈন্য ধলেশ্বরী পার হয়ে আমাদের দিকে আসতে চায়। ওই সময় তো আর রাস্তা ঘাট ছিল না, তাই কিছু কিছু বড় সড়ক থেকে কয়েক মাইল দূরে চলে গেলেই নিজেদের অনেক নিরাপদ ভাবা যেত।  কেননা ওসব জায়গায় আসার একমাত্র উপায় পায়ে হেটে বা নৌকায়।  যেহেতু আমাদের এদিকে, মানে বৈলতলায় আসার কোনো পথ ছিল না, এ দিকে পাক সেনা ঢুকতে পারে নি।  এবার তাদের নজর পড়লো এদিকে, তাছাড়া এলাকায় মুক্তিসেনা আছে বলেও শোনা যাচ্ছিলো।  তাই তারা এক মাঝির নৌকা ধরে ওকে বাধ্য করে  নদী  পার করে আনতে। মাঝিরা ছিল খুবই করিৎকর্মা।  বললো, ভালো হয় অন্ধকারে নদী  পার হলে, যাতে মুক্তিরা টের না পায়। আর নদীর মাঝামাঝি এসে সৈনিকদের  বলে ছৈয়ের নীচে  বসতে আর ছৈয়ের  মুখগুলো ভালো করে ঢেকে দেয় কাপড় দিয়ে যাতে মুক্তিরা  দেখতে না পায়, এমনকি হ্যারিকেনটাও নিভিয়ে দেয়।  তারপব সুযোগ বুঝে নৌকার তলা ফুটো করে নিজেরা সাঁতরে তীরে চলে আসে, আর পাক সৈন্যরা নৌকাডুবিতে বেঘোরে প্রাণ হারায়।  সাধারণ জেলেদের এই কাজ এলাকার মাসুষের বিশ্বাসকে চাঙ্গা করে তুলে, সবাই যেন দেখতে পায়, বিজয়টা আর তত দূরে নয়।

এই যে মাঝি - ওরা  ছিল একেবারে সাধারণ মানুষ, রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। নদীতে মাছ ধরে আর তা বিক্রি করে দিন আনে  দিন খায়। একাত্তরে এরকম লোকের সংখ্যা, যারা কোনো রাজনীতি করতো না, রাজনীতি বুঝতো না, অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হানাদারদের মোকাবিলা করেছে, তাদের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না।  তাই আজ যখন সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়, অবাক হই। বাংলাদেশের যারা স্থপতি এক সময় তারাই এই দেশে দ্বিজাতিতত্ত্বকে, অবিভক্ত ভারত ভেঙে মুসলিম পাকিস্তান গড়ার ভাবনাটাকে জনপ্রিয় করে তুলেন।  কিন্তু দেশ বিভাগের পরপরই দেখা যায়, শুধু ধর্মটাই আমাদের এক। ভাষা, আচার, বিচার, চলন, বলেন সবই ভিন্ন।  গতকালের ভাইয়েরা যখন আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, শোনা যায় প্রথম প্রতিবাদ।  এরপর বাহান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর আর সব শেষ এই একাত্তর। একাত্তরে আগে কিন্তু কখনোই স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠেনি। এমন কি ৭ ই মার্চের আগেও না, মানে এর আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ৭ ই মার্চ "তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুৰ মোকাবিলা করবা।" একেই হয়তো বলে লেনিনের সেই বিখ্যাত বাণী - "গতকাল ছিল  খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু  আগামী কাল খুব দেরি হয়ে যাবে  (Yesterday was too early, but tomorrow will be too late)।" জানি না, যদি  ইয়াহিয়া খান দু মাসের জন্য হলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করতো, তাহলে মানুষ এই মুক্তির ডাকে কিভাবে সাড়া দিতো। শেষ মুজিব শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর যাতে হয় তার, আর যখন সেটা হয় নি তখন তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন, ফলে মানুষের চোখে এই যুদ্ধটা ন্যায় যুদ্ধ বলে পরিগণিত হয়।  এর মনস্তাত্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো মামলায় ভালো উকিল নিয়োগ করতে হয় বা অসুখ হলে ডাক্তার ডাকতে হয়, যুদ্ধ লাগলেও তেমনি সেনাবাহিনী ডাকতে হয়। এতে করে  মনোবল বাড়ে।  তাই শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার পরও  সেনাবাহিনীর কোন উচ্চপদস্থ অফিসারের মুক্তিযুদ্ধের  সপক্ষে ঘোষণাটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  আর সে জন্যেই আওয়ামীলীগের চট্টগ্রামের তৎকালীন নেতা মেজর জিয়াকে দিয়ে আবারো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ান শেখ মুজিবের পক্ষ হয়ে। সঠিক ভাবে বলতে গেলে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা হান্নান প্রথমে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে পাঠ করেন আর এর পরে  হান্নান সাহেব, অন্যান্য আওয়ামীলীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের  অনুরোধে মেজর জিয়াও শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবারো পড়েন। এভাবেই দেশের মানুষ জানতে পারে সেনাবাহিনী বা সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদেরই সাথে। এটা নিঃসন্দেহে দেশের সাধারণ মানুষের মনোবল কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়া সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল, এটা মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভুমিকারী স্বীকৃতি। পঁচাত্তর ও পঁচাত্তর পরবর্তী তার ভূমিকা নিয়ে কথা উঠতেই পারে, সেটার সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু এই যে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক, স্বাধীনতার উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক - এটা  আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকেই খর্ব করে, স্বাধীনতার সর্বজনীন চেতনাকে দলীয় রাজনীতির খাঁচায় বন্দী  করে ফেলে।  এতে করে আর যেই হোক, দেশ, দেশের মানুষ লাভবান হয় না।

মস্কো, ২০ নভেম্বর ২০১৬                                     

Thursday, November 17, 2016

২১. কচুরি পানা



দিন আসে দিন যায়, একে  একে চলে যায় বসন্ত, গ্রীষ্ম।  বর্ষাও  যাই যাই করে, কিন্তু যুদ্ধ আর যায় না।  জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকে বুকের উপর।  এ যেন এক বিশাল অজগর, জাপটে  ধরে বসে আছে সারা দেশটা আর সময়ের সাথে সাথে পেষণটা হচ্ছে আরো আরো বেশী  শ্বাসরুদ্ধকর।  মা প্রায়ই বলে
- ঝড় আসে, ঝড় যায়।  এই যুদ্ধের দেখছি আর কুল-কিনারা নাই।  চলছে তো চলছেই, দিন নেই, রাত্রি নেই, অবিরাম এই চলে যাওয়া।  আর কত?
বাবা শান্তনা দেয়
- এতো উতলা হলে চলবে? যা হয় মঙ্গলের জন্যেই হয়।
- ধুত্তরি, ছাড়ো  দেখি তোমার মঙ্গল। তোমার মঙ্গলে জীবন ত্রাহি ত্রাহি।
বাবা আর কথা বলে না।  কিই বা বলার আছে।
সত্যি, এক ধরণের একঘেঁয়েমিতে  ভরে  যায় সবকিছু।  যুদ্ধের ডামাডোল আর কাউকে চাঙ্গা করে না, সব কেমন যেন পানসে লাগে।
এখনও  সবাই অপেক্ষা করে আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের ভরাট গলা শোনার জন্য, অথবা নীলিমা স্যান্নালের দেয়া যুদ্ধের খবর।  এম আর মুকুলের চরমপত্র এখন আর আগের মতো হাসায় না।  সবই কেমন যেন মনে হয়, দূরে, বহু  দূরে।  
আসলে রণাঙ্গন থেকে যে একটু আধটু খবর আসে, তা সীমান্ত এলাকার।  আমাদের এলাকায়, মানে মানিকগঞ্জে  যুদ্ধের দামামা তেমন বাজে না।  এখানে যুদ্ধুটা যেন লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।  মাঝে মধ্যে এখানে সেখানে কাউকে মারার খবর আসে, আবার সব চুপচাপ।  থমথমে এক পরিবেশ। ঝড়ের আগে যেমনটা হয়।  অবস্থা এমন, আজকাল ভয় পেতেও যেন আলসেমি লাগে, একঘেঁয়েমী  লাগে।  এমনি এক দিনে হঠাৎ দেখি মাখন কাকা বাড়ীর  পেছনে কচুরি পানা  জড়ো  করছে।
- কি হবে কাকা এই পানা দিয়ে?
- পরে গরুকে খাওয়াবো।  তাছাড়া শুকিয়ে জ্বাল দেয়া যাবে।  বলাতো   যায়না, কখন কি দরকার।

এখন বুঝি, এসবই  ছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার  বহিঃপ্রকাশ।  মানুষ যখন আগামী দিনের ছবিটা ঠিক দেখতে পায়না, তখন খড়কুটো যা পায়, সবই রেখে দেয়  যদি কাজে লাগে এই ভেবে।

জীবনে এত্তো  কচুরি পানা দেখিনি এক সাথে।  বইরাগীর  চক  দিয়ে ভেসে আসা পানা  নৌকা করে ধরে ধরে নিয়ে আসছে মাখন কাকা আর রাখছে বাড়ীর  পেছনের মাইট্যালে। পরে আমরাও নেমে গেলাম এই কাজে।  যাই হোক, কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে তো।

পানা  ছিল আমাদের কাছে অনেকটা রূপকথার মতো। ছোটবেলায় জেঠিমা গল্প করতো যে  ওই পানার উপর নাকি শ্রীকৃষ্ণ নেচেছিল, যেমনটা গোখরো সাপের ফণায়।  তাই গোখরো সাপের ফণায় যেমন শ্রীকৃষ্ণের পায়ের ছাপ, ঠিক তেমনি কচুরি পানাতেও আছে তার পদচিন্হ।  এদিক দিয়ে দেখতেগেলে শ্রীকৃষ্ণ   খুব স্মার্ট ছিলেন, যাতে ভক্তদের কষ্ট করে দূরদূরান্ত থেকে তার পদযুগলের খোঁজে যেতে না হয়, উনি নিজেই গোখরো সাপের ফণায় আর কচুরি পানায়  নিজ পদচিন্হ পাঠিয়ে দিয়েছেন ভক্তদের বাড়ী  বাড়ী।

আমাদের ওদিকটায়  কখনো পানা ধরে রাখতে দেখিনি।  আর এতো পানাও ছিল না আমাদের দিকে।  আমরা মূলতঃ  পছন্দ করতাম গাস্যির পানা। এই পানাগুলো ছোট ছোট, পাতাগুলো কোঁকড়ানো।  এখনকার ভাষার ন্যানো সাইজের  পানা  আর কি।  এই পানা আমরা ব্যবহার করতাম গাস্যিতে, তাই এই নাম।

কথায় বলে বারো মাসে তেরো পার্বন।   হিসেবে করলে ওদের সংখ্যা আরো অনেক বেশী। শুধু কার্তিক  মাসেই তিন তিনটে।  মাসের প্রথম দিন শুরু হতো আকাশবাতি দেয়া।  বাঁশ  দিয়ে একটা খোল (ঢোল) সাইজের কাঠামো করা হতো, আর ওটাকে লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা হতো। ওর মাঝখানে রাখা হতো প্রদীপ, মাটির বা পেতলের।  তেল, সলতাসহ।  তারপর প্রদীপ্ত জ্বালিয়ে পতাকা যেমন ওঠায় এই বাতিটাকেও ওঠানো  হতো লম্বা একটা বাঁশের  মাথায়, আকাশে।  আর বাঁশটা  পোতা থাকতো তুলসীর  ভিটার কাছে।  আকাশে  থাকতো, তাই নাম আকাশবাতি। পুরো একমাস ধরে এই বাতিটি প্রতিদিন   সন্ধ্যায় তোলা হতো আর সকালে নামানো হতো।  

কার্তিকের দ্বিতীয় পার্বন  ছিল এই  গাস্যি। সন্ধ্যায় দুপধুনা জ্বালানো হতো।  এর প্রধান উপকরণ ছিল গাস্যির পানা, নারকেলের ফোঁপা আর তালের আটি। পাকা (বাত্তি) নারকেল অনেক দিন থাকলে ওর ভেতর গজাতো এই ফোঁপা, বেশী বড়  হয়ে গেলে ন্যাকেলের চারা  বা গ্যাজ বেরিয়ে আসতো  নারকেল চিরে।  তালের ব্যাপারটা ছিল খুব মজার।  তাল কচি পারলে আমরা খেলাম তালের শাস বা তালের আটি।  ভেতরে একটু জল, জেলীর  মতো ব্যাপারটা।  আর তাল পাকলে বাইরের ছোবা  ঘষে হলুদ রঙের রস  বের করা হতো যা মুড়ি দিয়ে খেতাম।  কখনো ওটা জ্বাল দেয়া হতো।  করা হতো তালের বড়া, তালের পিঠা, তালের মালপোয়া।  আরো কত কি। আর ঐ পাকা তালের আটি  কল তলায় বা কোনো স্যাতস্যাতে জায়গায় পোতা হতো।  কিছুদিন পর ওখান থেকে তালগাছ উঁকি মারতো, আর আটির  ভেতরে হতো ফোঁপা। এই ফোঁপাটাই লাগতো গাস্যির কাজে।

কার্তিকের শেষ পার্বন  ছিল ভেলা-ভুইল্যা। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব।  দুটো  বাঁশ পেরেক দিয়ে গেঁথে  ক্রসের মতো বানাতাম,  আর নীচে  একটু জায়গা বাদে সবটা জড়িয়ে দিতাম ধানের  (আউশ ধানের) খর দিয়ে। সাথে ন্যাকরাও  জড়াতাম।  অনেকটা কাকতাড়ুয়া মতো, তবে মাথায় হাঁড়ি  ছাড়া। সন্ধ্যে হলেই ওতে কেরোসিন ঢেলে চলে যেতাম খোলা মাঠে। জ্বলে উঠতো আগুন। ওই জ্বলন্ত বাঁশের  ক্রস নিয়ে দৌড়াতাম আর গাইতাম

ভেলা আইলো ভুইল্যা যায়
ইচার  মুইড়া কুমিরে খায়

শুরু হতো লড়াই। ক্রস দিয়ে একে অন্যকে আঘাত করতাম যেন লাঠি খেলা বা তলোয়ারের লড়াই। শেষ ক্রসটা না পুড়া  পর্যন্ত চলতো এই লড়াই।  এভাবেই আমরা কার্তিককে বিদায় দিতাম, গ্রহণ করতাম অগ্রহায়ণকে।  এখন এই রাশিয়ায় যখন মাসলেননিৎসায় শীতের পুত্তলিকা দাহন করতে দেখি আমার মনে হয় সেই দিন গুলির কথা।  কত দূরের এই দুই দেশ, কত ভিন্ন এদের চলন-বলন,  অথচ কত  সামঞ্জস্য এদের কিছু কিছু অনুষ্ঠানে।  এদেশে মাসলেননিৎসা প্রাক-ক্রিষ্টান  যুগের, পৌত্তলিক।  যতদূর মনে পরে দেশে ভেলা-ভুইল্যার শেষে খাবার হিসেবে থাকবো মাছ আর বিভিন্ন পিঠা, এখানেও ওরা  অনেকটা পাটিসাপটা  জাতীয়  একটা পিঠা করে যার নাম blini.

মনে হয় কার্তিকের ওই পার্বন গুলো ছিল যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশী  প্র্যাকটিকাল।  ওই সময়ে দেশে আউশ ধান উঠতো।  পোকা  যাতে ধান নষ্ট না করে  তাই এই সব আগুনের আর ধোয়ার ব্যবস্থা।  তখন আজকালকার মতো এতো সার ছিল নাতো।

দুবনা, ১৭ নভেম্বর ২০১৬  





Wednesday, November 16, 2016

২০. লাশ

দিদিরা চলে যাবার পর বাড়ী  একেবারে খালি হয়ে গেলো। এখন রইলাম আমরা কজন।  জ্যাঠামশায় আর মেঝমা, কাকা-খুড়ীমা, বাবা-মা, সুধীরদা-বৌদি, তপনদা, রতন আর আমি।  বড়রা ব্যস্ত থাকতো নিজেদের কাজে আর  দিদিরা ঠিক মতো পৌছুলো কিনা সেই ভাবনায়।  ভাবনার তো শেষ নেই? এতো দিন ছিল এতগুলো লোকজনকে কিভাবে নিরাপদে রাখা যায় সেই চিন্তা, তাদের কিভাবে খাওয়ানো পড়ানো যায় সেই চিন্তা, এখন সেই লোকগুলো নিরাপদ জায়গায় পৌছুলো কিনা সেই চিন্তা।  এটাই জীবন।  এক সিঁড়ি পেরিয়ে পরবর্তীতে ওঠা, এক পা এগিয়ে পরের পাটা  কোথায় ফেলবো সেই জায়গা খোঁজা। এ এক অন্তহীন পথ, মাঝে মেঝে পরিচিত, তবে বেশীর  ভাগ সময়ই অপরিচিত পথে পা ফেলা, অজানার দিকে যাওয়া।  অন্তহীন পথে অবিরাম সংগ্রাম - এর নামই  জীবন।

সুধীরদা আগের মতোই স্কুলে যেত, আর যতক্ষণ না ফিরত সবাই টেনশনে থাকতো।  তপনদা বেশির ভাগ সময় কাটাতো পাশের পাড়ায়  শশীবাবুদের ওখানে।  তার ছেলে ভম্বল  ছিল ওর সমবয়সী।  তপনদা তখন সবে স্কুল শেষ করেছে, বয়স  ১৬ বা ১৭।  বাইরে যাবার জায়গা তেমন নেই আবার আমার মতো মার্ আঁচল  ধরে বসে থাকার বয়সটাও পার করে এসেছে অনেক দিন।

আমি আগের মতোই খেলি, এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করি।  বাড়ীটা  খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। আর বাবা-মাকে  প্রায়ই জিজ্ঞেস করি, দিদিদের খবর এলো কিনা? এদিকে জলও  কমতে শুরু করেছে। মদন মিস্ত্রী  আর নতুন করে ডুঙ্গা বানায়  না। তাই আমারও  হাতে সময় যেন আটকে গেছে, কিছুতেই যেতে চাইছে না।  দিদির হাতের তৈরী পুতুলগুলো নিয়ে খেলি, কখনো একা  একা, কখনো বৌদির সাথে। আমি ছোটবেলায় সব কিছু মনে রাখতে পারতাম,  কিন্তু এখন এই পুতুল খেলে বা মার্বেল খেলে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যাই।  বসে  থাকি খেলনা নিয়ে, একা একাই কথা বলি।  ওই খেলনাগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে আমার কথায়। ওই অন্যমনস্কতা, ওই নিজে নিজে কথা বলা - এসব আমার একাত্তর থেকেই পাওয়া।

এখন, সেদিন  থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও আমি হরহামেশা হারিয়ে  যাই নিজের মাঝে।  বৌ যখন কিছু একটা করতে বলে, আমি শুনলাম কিনা জানার জন্য কথাগুলো আমাকে রিপিট করতে বলে।  এমনও  হয় আমি রিপিট করি ঠিকই, কিন্তু একটু পরেই ভুলে যাই, সব ভুলে আওড়ে যাই

দাদখানি ডাল
মসুরের তাল
চিনি পাতা কই
ডিম্ ভরা বই
পথে পথে বলি
মনে মনে চলি
যদি হয় চুল
তবে মা নিশ্চয়ই ছিড়ে  দেবে ভুল।

অথবা রান্না করতে গিয়ে কিছু পুড়ে গেলে ঠিকই হাড়িপাতিলদের বকতে পারি।  যেমনটা পারি কম্পিউটার ঠিক মতো কাজ না করলে।  রাস্তায় সামনে মানুষজন না থাকলে দিব্যি চোখ বন্ধ করে হাটতে শুরু করি, বা উড়তে পারি, মানে ডানার মতো হাত নাড়িয়ে চলতে পারি।  আমার মনে হয়, যদি কেউ আমার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে আর আমার কথা বার্তা শুনে, ভাববে এখানে নিশ্চয়ই বেশ কয়েকজন লোক বাস করে।  একা  থাকার এ এক বিশাল সুবিধা।  অবশ্য ফিজিক্সে বা ম্যাথেমেটিক্সে যারা রিসার্চ করে, তারা মনে হয় এমনটাই হয়। অন্ততঃ  আমাদের কলিগদের দিকে তাকালে এটাই মনে হয়।

এভাবেই একা  একা  কাটতো সময়। বাড়ী  ভরা  মানুষ থাকতে যেসব করতে ভালো লাগতো, এখন আর তা লাগতো না।  এটা মনে হয় আজকাল ফেসবুকে লাইক পাবার মতো। যখন অনেক লোক ছিল, আমি ছোট বিধায় সবাই বাহবা দিতো, উৎসাহ দিতো, এখন লোকজন কমে যাওয়ায় লাইকগুলো কমে গেছিলো হয়তো। এরকম এক দিন হঠাৎ হৈচৈ শুরু হলো ঘাটে। দৌড়ে গিয়ে দেখি লাশ ভেসে যাচ্ছে খাল দিয়ে।  ফুলে ফেঁপে  হাতির মতো হয়ে গেছে, আর ওটার চারি দিকে জমেছে মাছের ঝাঁক।  বীভৎস এক দৃশ্য। জীবনে এই প্রথম লাশ দেখলাম, জলজ্যান্ত একটা মানুষের লাশ।  এতো দিন যুদ্ধের মৃত্যুগুলো ছিল শুধু কথা, শুধু শব্দ, আজ তার চাক্ষুস রূপ দেখলাম, নির্মম, নিদারুন রূপ।

ঠিক মনে নেই, ওই দিন বা তার কয়েকদিন পরে, শুনলাম পাশের জেলেরা যে ইলিশ মাছ ধরেছে তার পেটে আস্ত একটা হাত পাওয়া গেছে। নিজে দেখিনি, তবে বিশ্বাস করেছিলাম।  তখন নিজে ছোট ছিলাম, হাতও ছোট ছিল, তাই ইলিশের পেটে  হাত থাকতে পারে, এটা বিশ্বাস না করার কারণ ছিল না। গত সামারে মুকুল ভাই দুবনা  এলে এই গল্প শুনে  ও বললো, "আচ্ছা, তোমার কি মাথা খারাপ যে ইলিশের পেটে মানুষের হাত থাকবে?" হয়তো বা তাই। তবে ঐযে আমি ইলিশ মাছ খাওয়া ছাড়লাম, ওটা বজায় ছিল ২০১১ পর্যন্ত।  হিসেবে করে দেখলাম, এই ৪০ বছরে ওদের অনেক জেনারেশন চেঞ্জ হয়েছে, তাই এখন খাওয়া যায়।

আজ একটা জিনিস আমাকে খুব অবাক করে যে একাত্তরে আমি কখনো ভুতের ভয় পেতাম না।  বৈলতলার শেওড়া গাছ, মাদার গাছ বা দেবদারু গাছ দেখে মনেই হয় নি ওখানে ভুত থাকে।  অথচ নিজের গ্রামে আনাচে কানাচে ভুত থাকতো।  ঐতো, স্কুলে যাবার পথে পড়তো তাজুর বাগ।  বাঁশঝাড় আর গাব  গাছে ভরা।  ওখানে  ছিল     লাখো  ভুতের বাসা।  গলাকাটা ভুত ডুগডুগি বাজাতো, আর কেউ একা  গেলে তার সামনে ফেলে দিলো বাঁশ।  বাঁশটা হয় পাশ কাটিয়ে যেতে হতো, নয়তো ওটাতে পারা দিয়ে সামনে যেতে হতো। ডিঙিয়ে যেতে গেলে বাঁশটা  উপরে উঠে যেত, আর মানুষটা গিয়ে পড়তো ভুতের আস্তানায়।  তাই কোনো দিন একা  যেতে হলে বাগের  এক প্রান্ত থেকে চোখ বন্ধ করে সেকি দৌড়।  তবে স্কুলে যাওয়া যেত অন্য রাস্তা দিয়ে, মানে বড় খাল দিয়ে।  সেক্ষত্রে আমরা তাজু মাতব্বরের বাড়ীর  পশ্চিম দিক দিয়ে যেতাম।  আর সেখানে ছিল বিশাল এক তেতুল গাছ।  ওই গাছের ডালে ডালে নাকি ভুতের বাসা ছিল, সুযোগ পেলেই টুপ্ করে ধরে নিয়ে যেত মানুষজন।  

ওই লাশটা দেখার পর প্রথম দু একদিন একটু ইতস্তত করলেও পরে আবার জলে নেমেছি, সাঁতার কেটেছি, মাছ ধরেছি।  কখনোই ওই লাশটা ভুত হয়ে এসে ধরতে পারে বলে মনে হয় নি। মুক্তি যোদ্ধারা তো ভুত হয়না, শহীদ হয়।


দুবনা, ১৬ নভেম্বর ২০১৬  



Tuesday, November 15, 2016

১৯. বিদায়ের পালা

মাইল্যাগী আর বাঙ্গালায় স্বল্পকালীন কিন্তু অনিশ্চিত অবস্থানের পর আমরা আসি বৈলতলায়। অনেকাংশেই বৈলতলা হয়ে উঠে আমাদের আপন। প্রথমতঃ  বাড়ীর  মতোই এখানে ছিল অনেক প্রস্তর।  মাইল্যাগী  আর বাঙ্গালায়  ছোট্ট বাড়িতে আমরা অস্বস্তি অনুভব করছিলাম, এখানে অনেক বড় বাড়িতে আমরা যেন আবার নিজেদের ফিরে পাই, কাউকে বিরক্ত না করেই নিজেদের মতো নিজেরা চলার আর থাকার সুযোগ পাই।  দ্বিতীয়তঃ  এখানেই  আমরা প্রথম আবার সবাই, মানে বাবা-কাকা-জ্যাঠামশাই, এক সাথে থাকার সুযোগ পাই।  ব্যাপারগুলো আপাতঃ  দৃষ্টিতে খুব ক্ষুদ্র মনে হতে পারে, তবে আজন্ম গড়ে উঠা  পরিবেশ বিপদের সময় মানুষকে মানসিক শক্তি দেয়। মানুষকে পথ দেখায়, বিপদের মোকাবেলা করতে সাহায্য করে। কথায়  বলে নিজের বাড়ীর  দেয়াল পর্যন্ত গৃহস্থের  হয়ে লড়াই করে। ঘর তো  শুধু  ইট-পাথর নয়, ঘর - সবার আগে ঘরের বা পরিবারের মানুষগুলো।  তাইতো যুদ্ধের সময়ই  হোক আর শান্তির সময়ই হোক, পরিবারের  সবাই ঘরে ফিরে আসলে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।

বৈলতলায় আমরা সবাই শুধু একসাথে থাকতামই  নয়, এখানেই  ধীরে ধীরে শুরু হয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা, মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবা।  আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে ভেসে আসা আশার  বাণী আমাদের মনে সাহস জোগাতো।  ওই স্বপ্নের হাত ধরেই জীবন ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছিলো স্বাভাবিকতার দিকে, এমনকি  সুতার ব্যবসাটাও হাটিহাটি  পা পা করে এগুচ্ছিলো সামনের দিকে। এই ব্যবসা শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই  মেটাতো না, যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলিয়ে রাখতো, এটা ছিল এই ভয়াবহ সময়ে  অনেকটা মরুদ্যানের মতো।

তাই একদিন যখন দিন দুপুরে রাজাকার এলো বাড়ীতে , সময় এলো নতুন করে সবকিছু ভেবে দেখার, জীবনটা নতুন করে ঢেলে সাজানোর। এই আক্রমণ আমাদের বুঝিয়ে দিলো কত ভঙ্গুর ছিল আমাদের নিরাপত্তা, কত সহজ ছিল মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু তছনছ করে দেয়া।  বাবা-কাকারা বাড়ীর  মেয়েদের বিশেষ করে দিদি আর চন্দনার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্থ হলো। এদিকে রাজাকারদের হাতে ধরা পরে কল্যাণদাও ভয় পেয়ে গেলো।  সব মিলিয়ে সময় এলো সিরিয়াসলি সব কিছু নতুন করে ভাবার।  আমার মনে হয় মাইল্যাগী  বা বাঙ্গালা  থেকে যত সহজে আমরা কোথাও  সরে পড়তে পেরেছি, এখন আর সেটা সম্ভব ছিল না।  প্রথমতঃ  তাতে করে আবার সবাইকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে হতো, দ্বিতীয়তঃ  ব্যবসাটা শুরু হওয়ায় বড়রা  আবার নতুন কর্মকান্ডে  জড়িয়ে পড়েছিল।  শুধু যেতে চাইলেই  তো হবে না, কোথায় যাওয়া যায় সেটাও ভাবতে হবে, সেখানে কতটুকু নিরাপদে থাকা যাবে, কিভাবে সংসার চলবে - এ প্রশ্নগুলোর উত্তরও  দিতে হবে।  তাছাড়া যতই দিন যাচ্ছিলো, কুদ্দুস ভাইদের মতো লোক, যারা এই বিপদের দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তাদের সংখ্যাও কমছিল।  সব মিলিয়ে একেবারে নতুন ধরণের সমাধান খুঁজছিলো সবাই।

যুদ্ধ চলছিলো ঠিকই, তবে সেই সাথে বিভিন্ন ভাবে আত্মীয় স্বজনদের সাথে  যোগাযোগও  রক্ষা করে চলছিলাম আমরা।  তখন ইন্টারনেট ছিল না, ফেসবুক ছিল না, টেলিফোনও ছিল নামমাত্র, তাই যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল চিঠিপত্র।  এখন যেমন আমরা ঘুম  থেকে উঠেই প্রথমেই ই-মেইল চেক করি, যুদ্ধের আগে এবং পরেও আমরা তেমনি করে প্রতিদিন যেতাম ডাকঘরে চিঠি  এলো কিনা তা দেখতে।  এমন দিন খুব কমই  ছিল, যেদিন আমাদের বাড়ীতে  চিঠি আসতো  না।  মামারা লিখতো প্রতি সপ্তাহে, লিখতো দাদারা।  চার দাদা কলকাতায় পড়াশুনা করতো,  চার মামা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় থাকতো।  আমার নিজের চার মামা আর এক মাসী  - সবাই ওপারের বাসিন্দা, কেউ দেশ ভাগের আগে থেকেই, কেউ বা পরে যায়।  একমাত্র মা-ই  এদিকটায় রয়ে গেছিলো।  মাসীমা ছিল সবার বড়, দু বোনের পর চার মামা। তাই ওরা  পালা করে নিয়মিত মাকে লিখতো। এমন কি আমার মেঝো মামা, অমূল্য সিংহ, যে নিজের মতো করে নিজেকে গড়বে  বলে বাড়ী  থেকে পালিয়ে জয়ন্ত চৌধুরী হয়ে যায়, সেই মামাও তার ছোড়দিকে নিয়মিত লিখতো।  ওদের চিঠি আসতো  আমাদের বাড়ীর  ঠিকানায়, সালাম ভাই সেগুলো দিয়ে যেত।  আর আমরা উত্তর লিখতাম, তা পোষ্ট  করা হতো যেসব  জায়গায় থাকতাম  তার থেকে দূরে কোনো ডাকঘর থেকে, যাতে পোষ্ট অফিসের সূত্র ধরে কেউ আমাদের খোঁজ না পায়।

ওখানে থেকেই প্রস্তাব আসলো দিদিদের কলকাতা পাঠানোর।  তবে আগে রাস্তা ঘাট দেখার জন্য গেলো শ্যামলদা আর দিলীপ মামা। শ্যামলদা - আমাদের জ্যাঠতুতো ভাই, আর দিলীপ মামা বড়দির ছেলে। ওরা  তখন কলেজের ছাত্র। দিলীপ মামা খুব ভালো গান গাইতো। শ্যামলদা সারাজীবন গ্রামের বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেই গেলো।  যাকগে, একদিন ওরা  চলে গেলো আমাদের পেছনে ফেলে। শুরু হলো অপেক্ষার পালা।  কখন খবর আসবে ওরা দুজন নিরাপদে পৌঁছেছে সীমান্তের ওপর। মনে হয় মাস খানেক  পর ওদের পৌঁছুনোর খবর এলো।  এখন দিদিদের ওদিকটায় পাঠানো যায়।

এর মধ্যে আমাদের গ্রামের চুনী  বাবু (চুনী বসাক) ভারত যাবে বলে ঠিক করলো।  ওদেরও  বিরাট সংসার - দুই ছেলে, চার মেয়ে - এক মেয়ে দিদির সমবয়সী, বান্ধবী। একদিন আমাদের ঘটে এক বিশাল নৌকা ভিড়লো, আমরা বলতাম গোপালগঞ্জের নৌকা বা বাদামী নৌকা।  এই নৌকাগুলো ধান-পাট  নিয়ে যেতো  এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। বর্ষার সময়ে কালিগঙ্গা দিয়ে কত গোপালগঞ্জী নৌকা যে যেত, তার হিসেবে রাখে কে? ওদের ছিল বিশাল পাল, তেমনি বড় হাল আর অনেকগুলো বৈঠাওয়ালা।  কখনো কখনো পালে  বাতাস না থাকলে উজান পথে এই বৈঠাওয়ালারা  গুন টানতো।  দিদি, চন্দনা, রঞ্জিতদা আর কল্যাণদাকে চুনী  বাবুর হাতে তুলে দিয়ে চোখের জল মুছলো মা-খুড়ীমা। হঠাৎ করেই বাড়ী  যেন খালি হয়ে গেলো, শুরু হলো নতুন করে অপেক্ষার পালা।  এক দিন এই পথ চেয়ে থাকায় শেষ হলো, প্রায় দুই  মাস পরে খবর এলো ওদের সীমান্ত পার হবার।  সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস  ফেলে বাঁচলো।

মানুষের দু ধরণের গল্প থাকে - সাফল্যের কথা আর ব্যর্থতার কথা।  ব্যর্থতার কথা কেউ বলতে চাইলেও খুব কম লোকই তা শুনতে চায়, আর যারা সফল তারা সাক্সেস  স্টোরিই বলে এই সাফল্যের পিছনে  হাজারো কষ্টের কথাটা সযত্নে গোপন রেখে।  অনেকটা এলাম, দেখলাম, জয় করলাম টাইপে। আশির দশকের শেষ দিকে রাশিয়া যখন বিদেশী ছাত্রদের অনুমতি দেয়  বাইরে (সিঙ্গাপুর, তুরস্ক বা ইউরোপ) গিয়ে কম্পিউটার আর গার্মেন্টস নিয়ে আসতে, আমাদের অনেক বন্ধুরাই সেই সুযোগ গ্রহণ করে।  এর আগে এ দেশে এসব কাজকে চোরাচালানী  বলে মনে করা হতো, আর ধরা পড়লে শাস্তিও হতো।  আমরা যারা সমাজতন্ত্রে আর সোভিয়েত  সিস্টেমে বিশ্বাস করতাম, এসব করতাম না।  তবে নতুন বাস্তবতায় অনেক বন্ধুরাই বাইরে যেতে শুরু করে, অনেকেই রাতারাতি বেশ সম্পদের মালিক হয়।  আমি তখন যেমন, এখনো তেমনি খুশী  হই, যখন দেখি আরো একজন বন্ধুর অবস্থা ঘুরলো।  লক্ষ্মীর সাথে আমার  সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না।  আসলে শুধু লক্ষ্মী কেন, কোনো  দেব দেবীর  সাথেই আমার সম্পর্ক ভালো  নয়।  ভগবানের সমালোচনা করবে, আর তার বৌ-বাচ্চা-বন্ধু-বান্ধবের সাথে খাতির থাকবে তা তো হয় না।  ওখানে মীরজাফররা এখনো জন্মেনি মনে হয়। বন্ধুদের সচ্ছলতায়  খুশী কারণ - পটেনসিয়ালি  ওরা  লোন  দিতে পারে, তাছাড়া এটা  হলে অন্ততঃ  ওদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।  কেউ আর্থিক বিপদে পড়লে টাকার বস্তা নিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারি না ঠিকই, তবে ওদের জন্য মনটা খারাপ তো করতেই পারি।

যাকগে, একদল বন্ধুর অবস্থা ফিরলে সুবিধার সাথে সাথে কিছু অসুবিধাও দেখা দিলো।  সুবিধা গুলো হলো, ওদের ওখানে আড্ডা হতো, খাওয়া দাওয়া হতো, ট্যাক্সি করে ঘুরা  হতো - এক কোথায় লাইফে একটা এলিটি ভাব এলো।  কিন্তু বলে না, মানুষ অভ্যাসের দাস।  এক বার অভ্যেস হয়ে গেলে সে আর তার পকেটের কথা ভাবে না।  আমিও  তাই।  তাই এক সময় দেখা গেলো, একটু একটু করে শীতের তাপমাত্রার মতো আমার পকেটের তাপমাত্রাও মাইনাসের কোঠায়  চলে গেলো।  এক বন্ধু  বললো, তুরস্ক থেকে জ্যাকেট নিয়ে আয়, আমি টাকা দেব, বিক্রির ব্যবস্থা করবো।  আমার রুমমেট যাবে তোর সাথে, তোকে শুধু গেলেই হবে, কিছু করতে হবে না।  আরেকজন বললো,"বিজন দা, আমি কয়েকদিন আগে তুরস্ক থেকে ঘুরে এলাম।  গেলাম, এটা-ওটা কিনলাম, এখানে বিক্রি হলো, মাত্র দুই সপ্তাহে নীট  লাভ এতো।  আপনি যান, কোনো প্রব্লেম হবে না।" আমিও ভাবলাম, এই সুযোগে একটা দেশ দেখা হবে, কিছু ছবি তোলা হবে।  রাজি হয়ে গেলাম।  রুমমেট আর গেলো না।  ট্রেনে আলাপ হলো এক অস্ট্রেলিয়ান বাহাঈয়ের  সাথে।  আর ছিল ওডেসা থেকে কিছু নাইজেরিয়ান ছেলে।  ওরাই নিয়ে গেলো বিভিন্ন জায়গায়। ওরা  মার্কেটিং করে, আমি ছবি তুলে বেড়াই।  ওদের কাজ শেষের দিকে। বললো, "বিজন  তাড়াতাড়ি করো, একটু পরেই ট্রেন।" আমি তাড়াহুড়া করে কয়েকটা দামী  জ্যাকেট কিনলাম, নিজের জন্য সোয়েটার, আর কয়েকটা এমনি সোয়েটার বিক্রির জন্য।  দোকানদার কত কথা বললো, বাংলাদেশের গল্প শোনালো।  আমি তো আনন্দে গদগদ।  পরে মস্কো ফিরে দেখি সোয়েটারগুলো ছেড়া। জ্যাকেট অনেক দামী, তাই বিক্রি করে লাভ  গেলো না।  এদিকে যে ছেলে কয়েক দিন আগে ঘুরে এলো আর আমাকে যেতে উৎসাহিত করলো, ওর ঘরে জ্যাকেট কিনতে  এসে ফ্রাইপ্যান দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে  বিনে  পয়সায় সব নিয়ে গেছে, ও হাসপাতালে।  আমার ধার শোধ তো হলোই না, বরং ধারটা আরো বেড়ে গেলো।

রাশিয়ার গল্পটা করা এ জন্যেই যে, আমরা অনেক সময় রেজাল্ট জেনেই ওই ফলাফলে আসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।  আমি যখন এই লেখাটা শুরু করি, মনেই হয়নি এতো কিছু মনে পরবে। অনেক সময় খারাপ লাগে ভেবে যে, যখন বাবা-কাকারা বেঁচে ছিল, তাদের কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাই এবার ঠিক করলালম দিদিকে ওদের ইন্ডিয়া যাবার কথা জিজ্ঞেস করবো।

- দিদি, তোর মনে আছে ইন্ডিয়া যাবার কথা?
- হ্যা, থাকবেনা কেন?
- বলবি একটু  বিস্তারিত?
- ঐ তো শ্যামলদা আর দিলীপ মামা চলে যাবার পর আমরা চুনী  জামাইবাবুর সাথে রওয়না হলাম। সারাদিন থাকতাম নৌকার খোলে, উপরে পাট  দিয়ে ভরা।  নৌকা চলতো কখনো দিনে, কখনো বা রাতে।  রাত পোহানোর আগে চরণদার (মানে নৌকার ক্যাপ্টেন) আমাদের নামিয়ে দিত নদীর পারে।  অন্ধকারে কোথাও বসে প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে নদীতে স্নান করে আমার নৌকার খোলে ঢুকতাম।

আমি ভাবতেই পারিনি ওদের নৌকার খোলে অর্থাৎ নৌকার তলা আর পাটাতনের মাঝের জায়গাটায়  থাকতে হয়।

- তার পর?
- কথা ছিল এক মাস পরে পৌঁছে যাবো। সেখানে সময় লাগলো দুমাস।  সাথে যে খাবার দাবার এনেছিলাম, সব শেষ।  শেষের দিকে অনেক জলের মধ্যে একটু চাল  ছেড়ে দিয়ে ওটাই খেয়ে থাকতাম। কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা।  পুড়িয়ে দিতো সামনের  নৌকা, বা ডুবিয়ে দিতো।  চরণদার ছিল মুসলমান, সে খুব কায়দা করে আমাদের লুকিয়ে রাখতো, আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে সামনে এগুতো।
- তা তোরা শেষ পর্যন্ত পৌছুলো কোথায়?
- আমরা উঠলাম গিয়ে ধূপগুড়ি। কিন্তু সেখানে রিফিউজি দিয়ে ভর্তি, থাকার কোনো জায়গা নেই, বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না।  আমরা এতোগুলো লোক।  তারপর অনেক কষ্টে এক বাড়িতে একটা ফাঁকা গোয়াল ঘর ভাড়া পেলাম। গরুটা নাকি কয়েকদিন আগেই বিক্রি হয়ে গেছিলো।  বাড়ীর  সাথেই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।  ওরা  সকাল বিকাল ট্রেনিং নিতো, আমরা ওখানে গিয়ে দেখতাম।  এভাবে কাটলো একমাস।  খুব কষ্টের একমাস। আমাদের হাতে তো তেমন টাকা পয়সা দিয়ে দেয়  নি।  কল্যাণ আর রঞ্জিতদার পেট ভরতো  না এতো অল্প খাবারে, ওদের জন্য খাবার কিনতে হতো।  এভাবে ওখানে একমাস কাটানোর  পর গেলাম চুনী  জামাইবাবুর বড় মেয়ের বাড়ী।  ওখানেও কাটলো একমাস।  ওখানে দুয়ার ঝাড়ু  দিতে হতো, বাসন মাজতে হতো।  বাড়ীতেতো  কোনো দিন এসব করিনি, কিন্তু কি আর করা। এভাবেই রইলাম।  এর মধ্যে ভাগু দাকে চিঠি দিলাম, তবে ওরা আসছিলো না।  চুনী  জামাইবাবু শুধু বলতো, ওরা  তোদের কথা ভুলে গেছে।  শেষ পর্যন্ত শ্যামলদা এলো ভাই ফোঁটার  আগের দিন।  ওদের ভাই ফোঁটা  দিলাম, আর ওই দিনই কলকাতা রওয়না হয়ে গেলাম। রাত  কাটলো স্টেশনে, ট্রেন আসলে তো যাবো? কলকাতায় উঠলাম গিয়ে বেহালায়  ভাগুদার বাসায়।  স্বপনদা একদিন এলো দেখা করতে।  পরে শুনলাম ওর কোনো খবর নেই।  ও নকশাল আন্দোলনে  যোগ দিয়েছে। ওখানে রইলাম আরো মাস দুয়েক।  তারপরতো  দেশ স্বাধীন হলো, চলে এলাম স্বাধীন দেশে।

দিদিরা কলকাতায় পৌঁছানোর পর আমাদের খবর দিয়েছিলো।  জানি না, পরে বাবা-মাকে  দিদি এসব গল্প বলেছিলো কিনা, তবে আমি শুনেছি বলে মনে পরে না।  ওরা  যে নিরাপদে পৌঁছেছে এই আনন্দেই পথের কষ্টের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছিলাম। সব ভালো যার শেষ ভালো - কথাটা হয়তো এ কারণেই বলে।

দিদিরা চলে যাবার পর আমাদের শুরু হয় নতুন জীবন।  আবার নতুন করে ঢেলে সাজাতে হয় জীবনের  প্রতিটি মুহূর্ত।


দুবনা, ১৬ নভেম্বর ২০১৬





Sunday, November 13, 2016

১৮. ছানা রাজাকার

দিন যায়, জল বাড়ে, বাড়ে ভয়।  যখন বাড়ীর সামনে খাল শুকনো ছিলো  তখন আর যাই হোক, সবার অগোচরে শত্রু, মানে পাকবাহিনী বা তাদের দেশীয় সাগরেদদের আসাটা  ছিল বলতে গেলে অসম্ভব।  যেহেতু আমাদের পরিবার তৎকালীন মানিকগঞ্জ মহুকুমায় বিভিন্ন ভাবেই সুপরিচিত ছিল, তাই যেখানেই থাকি না কেন, সবার অগোচরে থাকা ছিল সত্যিই অসম্ভব।তারপরেও যে এতদিন আমরা বলতে গেলে আপেক্ষিক ভাবে নিরাপদেই ছিলাম, এটা  সেসব জায়গায় ছিলাম, সেই এলাকার পাইকার, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মাতব্বরদের আর সর্বোপরি মানুষের ভালোবাসার কারণে।  এটা মনে হয় এ কারণে যে, কারো সাথেই জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলা আমাদের ছিল না, বাবা কখনও  খদ্দেরদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো না, বরং যদি কেউ বিপদে পড়তো, চেষ্টা করতো তার পাশে দাঁড়াতে। তাই এতদিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস ছিল, যে এলাকায় মিলিটারি আসার আগেই কেউ না কেউ  আমাদের খবর দেবে, সাহায্য করবে সময় মত  নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে।  কিন্তু জল বাড়ার সাথে সাথে পাশের খাল যখন হয়ে গেলো মহাসড়ক, যখন নদী পথে যে কেউই অনেকটা অগোচরেই চলে আসতে পারতো মাখন কাকার বাড়ীতে  আর বর্ষার কারণে পালানোও ছিলো  যথেষ্ট কষ্টসাধ্য, আগের সেই সাহসটা আর রইলো না।  তাই সারা দিনই, বিশেষ করে দিনের বেলায় কেউ না কেউ থাকতো ঘাটে, যাতে সন্দেহজনক কোনো নৌকা আসলে আগে থেকেই সাবধান করে দিতে পারে সবাইকে।  আর বাড়ীর  ঘাট থেকে যেহেতু অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত, তাই ওটাই ছিল একমাত্র ভরসা কোনো ধরণের অকস্মাৎ আক্রমণ এড়ানোর।

এভাবেই ভয়-ভীতি আর আশা-আকাঙ্খার মধ্যেই কাটছিলো দিনগুলো।  যেদিনটির কথা বলছি  সেটাও শুরু হয়েছিল অন্য দিনগুলোর মতোই। সবাই যে যার মতো করে সময় কাটাচ্ছিল।  ছোটকাকা রতনকে নিয়ে গেছিলো ঘিওর সুতা আনতে।  নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা পাঠাতো ঘিওরে, ওখান থেকে তা বৈলতলা এনে রং করে বিক্রী  করতো কেরানীনগরের হাটে। এটা আমার অবশ্য মনে ছিল না, মানে ছোটকাকা আর রতনের ঐ  দিন ঘিওর যাবার কথা।  তবে লেখাটা শুরু করার পর রতনের সাথে কথা বলে  জানলাম ওরা নাকি ঘিওর গেছিলো। মা-মেঝমারা ছিল বাড়ির পেছনের দিকটায় যেখানে রান্না হতো, কল্যানদা  চলে গেছিলো একা  একা  নৌকা বাইতে। বাবা, মাখন কাকা আর জ্যাঠামশায় বসে গল্প করছিলো বাড়ীর  বাইরের দিকটায় যেখান থেকে পুরো খালটা দেখা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। আমি নিজে ঠিক কোথায় ছিলাম হলপ করে বলতে পারবো না। কখনো মনে হয় আমি বাবার পাশেই বসে ছিলাম আবার কখনো মনে হয় বাইরে গন্ডগোল শুনে মা আমাকে ওখানে পাঠিয়েছিল  কি হয়েছে সেটা জানতে।

যাই হোক, হঠাৎ একসময় শোরগোল উঠলো একটা নৌকা আসছে আমাদের দিকে, অনেকটা একমালিয়া নৌকার মতো, ছই ওয়ালা।  একমালিয়া নৌকা - এটা মাঝারি আকারের নৌকা, যেখানে একজন মাত্র চালক বা মাঝি  থাকে।   নৌকার  সামনের দিকটা, মানে যেদিক দিয়ে মানুষ নৌকার উঠে, নীচু , জলের খুব কাছাকাছি, আর পেছনের দিকটা বেশ উঁচু, দা যেমন বেঁকে উপরে উঠে যায়, ঠিক তেমনটাই।  যার ফলে  নৌকার পাটাতন বা ফ্লোরটা একটু ঢালু। যেহেতু এই নৌকা ব্যবহার করা হয় যাত্রীবাহী যান  হিসেবে, এর মাঝখানটা থাকে ছই বা ঢাকনি দেয়া। ছই তৈরী হয় বাঁশ  দিয়ে।  ঐসব দিনে এমনকি যুদ্ধের পরেও, দেশে যখন রাস্তা-ঘাট এতো উন্নত ছিল না, গ্রামে গঞ্জে যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল পায়ে হেটে বা বর্ষায় নৌকা করে, একমালিয়া নৌকা ছিল অনেকটা নদীর বেবী  ট্যাক্সির মতো, মানে রিকশার (অর্থাৎ ডুঙ্গা নৌকার) মতো খোলা না, আবার ট্যাক্সির (পানসি নৌকার) মতো মত  আরামদায়ক আর ব্যয়বহুল না। সাধারণতঃ  বৃষ্টির সময় ছই এর সামনে পর্দা টেনে দেয়া হতো, যদিও কখনো কখনো খানদানী  পরিবারের মহিলারা কোথাও গেলেও ছই এর সামনে পেছনে ঢাকনা বা পর্দা লাগানো হতো।  যাই হোক সময় যুদ্ধকালীন, তাই এই সময় ঢাকনা দেয়া ছই ওয়ালা নৌকা দেখে সবার মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো, শুরু হর শোরগোল আর সবাইকে বলা হলো বাড়ি থেকে সরে যেতে, বলতো যায় না?

আমার শুধু মনে আছে মাখন কাকা বেশ কয়েকবার চিৎকার করে কে আসছে কে আসছে বলে জিগ্যেস করার পরও  কোনো উত্তর না পেয়ে সবাইকে পালাতে বলে।  নৌকাটা যখন আমাদের ঘাটের কাছাকাছি এসে গেছে, তখন আমি দৌড়ে চলে যাই ভেতর বাড়ী  মা-মেঝমাদের পালাতে বলার জন্য।  সবাই জড়ো  হই  ঘরের পেছন দিকটার দেবদারু গাছের নীচে।  মা বার বার জিজ্ঞেস করে বাবা কোথায়? আমি অনেকটা বানিয়েই  বলি, পালিয়েছে মাখন কাকার সাথে, আমাদের পালাতে  বলেছে।  ঘাটে  তখন ছোট একটা ডুঙ্গা  ছিল।  ওখানে মেঝমা, বৌদি, দিদি, রঞ্জিতদা আর আমি উঠে বসি।  মা সাঁতার জানতো না, তবে জোর করে বললো আমরা যেন  দিদি-বৌদিকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাই।  আসলে রঞ্জিতদা বা আমিও সাঁতার জানতাম না, আর সময় ছিল না।  মা ওখানেই জলে নেমে রয়ে গেলো, আমরা চলে গেলাম একটু দূরে অন্য এক বাড়ীতে।  জানি না কত সময় ওখানে আমরা ছিলাম, তবে এটা ছিল একাত্তরের সবচেয়ে অনিশ্চিত কয়েক ঘন্টার একটা।

আমার কেন যেন কয়েকটা ছবি মনে পড়ছিলো, এখনো পরে, যদিও পরবর্তী ঘটনা থেকে সঠিক কি ঘটেছিলো তা  বেছে নিতে সমস্যা হয় না।

ওই ছবিগুলোর একটা ছিল, বাবা, কাকা (যদিও এখন মনে হয় জ্যাঠামশায়, যেহেতু রতনের ভাষায় কাকা আর ও ঘিওর গেছিলো ওই দিন) আর মাখন কাকা বসে গল্প করছিলো আর আমি বসে বসে পাটখড়ি দিয়ে মাটিতে কিছু লিখছিলাম বা আঁকছিলাম (ওটা আমার প্রিয় কাজগুলোর একটা, এখনো দেশে গেলে মাটিতে লিখি, ছবি আঁকি।) ঠিক ওই সময় নৌকাটা চোখে পরে আর মাখন কাকা জোরে জোরে জিজ্ঞেস করতে থাকে কে আসছে। উত্তর না পেয়ে উনি বাবা আর জ্যাঠামশায়কে নিয়ে বাড়ীর  অন্যদিকে চলে যায় ওখান থেকে পালাবে বলে আর আমাকে বলে এদিক দিয়ে মা-মেঝমাদের নিয়ে পালিয়ে যেতে। বাবা চাইলো এদিকে এসে মা-মেঝমাদের খবর নিতে, জ্যাঠামশায় এক রকম ধমক দিয়ে বাবাকে নিয়ে যায়।

অন্য ছবিটা ছিল, নৌকা থেকে আর্মিরা নেমে আসে আর বাবার দিকে তাক করে বন্দুক ধরে।  আমি এরই মধ্যে দৌড়ে ভেতরে চলে যাই মাদের  সাবধান করতে।  যেহেতু গুলীর শব্দ পাইনি, তাই আর যাই হোক, বাবাকে গুলী  করেনি, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলাম, তবে এই রকম পরস্পর বিরোধী ছবি আমাকে কিছুতেই শান্তি দিচ্ছিলো না। এছাড়াও মা রয়ে গেছিলো, তাই কান্নাকাটি না করলেও প্রচন্ড উৎকণ্ঠায় কাটছিলো সময়।  মাকে  আনতে  যাবার উপায় ছিল না, কেননা তাহলে নিজেদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল।

আজ আমি অবাক হই, যদিও আমার সামনে দুটো ছবি ভাসছিলো, কিভাবে আমি মাকে বললাম বাবা পালিয়ে গেছে, চল আমরা পালাই।  ওই সময় আমাকে নিয়ে বেশ কিছু গল্প আমি শুনেছি অনেক বার।  আমার বয়স  যখন ছয় মাস, আমাদের বাড়ীতে ডাকাত পরে। দরজা ভেঙে ডাকাতরা ঢুকে পরে আমাদের ঘরে। এক ডাকাত যখন বাবার বুকে চাকুর আঘাত করে মা এসে দাঁড়ায় বাবার সামনে, আঘাত লাগে মার থুতনিতে।   অজ্ঞান হয়ে পরে যায় মা, বাবাও অজ্ঞান হয়ে পরে যায় ডাকাতদের আঘাতে।  পরে ডাকাতরা  আমাকে ন্যাকড়া দিয়ে পেঁচিয়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়  পুড়িয়ে মারবে বলে, যখন স্বপনদা অনেক কাকুতি-মিনতি করে ডাকাতদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র স্বপনদা এই ঘটনায় এতো ভয় পায় যে, কয়েকদিন পরেই কলকাতা চলে যায়। এর পর আর কখনো দেশে ফেরেনি। এখন  ওখানেই ডাক্তারী  করে। আমার যতদূর মনে হয়, ওই গল্পই  আমাকে বলে দেয় যদি না বলি  বাবা মাখন কাকার সাথে পালিয়ে গেছে, মা বাড়ী  থেকে এক পাও নড়বে না।

বড় হয়ে কতবার যে এই রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়েছে! এখনো মনে পরে দুটো ঘটনা, এখনো শিউরে উঠি।

২০০৪ বা ২০০৫। শনিবার সন্ধ্যায় আমরা সাঁতার কাটতে যেতাম। আমি মনিকা, ক্রিস্টিনা আর মনিকার বান্ধবী লিজা।  ওদের বয়স  তখন ৬ আর ১০।  সেদিন ও যাচ্ছি।  পথে আমাদের রেললাইন ক্রস করতে হয়।  যখন রেললাইনে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ এক চোখ ধাঁধানো সার্চ লাইটে মনে হলো লাইনের ওদিকে গাড়ি যাচ্ছে। তাই ওদের বললাম লাইনের উপরেই অপেক্ষা করতে।  আর ঠিক সে মুহূর্তে বেজে উঠে  ট্রেনের  হৃদয় বিদারী হুইসেল। "লাফাও সবাই" বলে কোনো রকমে লাইন থেকে নেমে যাবার পর ট্রেনটা চলে গেলো আমাদের পাশ দিয়ে।  এখনো মাঝে মাঝে কানে বাজে ট্রেনের সেই হুইসেল।  

২০০৫।  সবাই মিলে যাচ্ছি বাচ্চাদের একটা অনুষ্ঠানে।  সেভার বয়স  তখন ৩ এর কাছাকাছি। ওকে আমি সাইকেলে বসিয়েছি, মানিক, ক্রিস্টিনা, লিজা, ইউৱা  আসছে হেটে। লিজা আর ইউরার বাবা আনাতোলি ভানিয়াকে নিয়ে আসছে পেছনে পেছনে। যেহেতু ওরা অনেকটা পেছনে, রেললাইন পার হবার আগে লাইন থেকে মিটার ১৫ দূরে আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি ওদের জন্য। সেভা  নেমে পড়েছে সাইকেল থেকে। আর আমি ডাকছি মনিকাদের তাড়াতাড়ি আসতে। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি সেভা  হাটতে হাটতে এগিয়ে যাচ্ছে রেললাইনের দিকে,  আর ওদিক থেকে আসছে ট্রেন।  আমি শুধু মনিকাদের ইশারায় বললাম কিছু না করতে,  কেননা সেভাকে ধরতে গেলে ও দৌড়ে সামনের দিকে যেতে পারে। ও একটা সময় চলন্ত ট্রেন থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো আর আমি রইলাম অপেক্ষায় কখন  ট্রেন চলে যাবে আর আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরবো।  এটা ছিল সেপ্টেম্বর, বেশ ঠান্ডা ছিল বাইরে, কিন্তু মনে হয় ওই দুই -তিন  মিনিটে আমি ঘামে নেয়ে উঠেছিলাম।

এগুলোকেই আমি  বলি রূপকথার সেই তিন রাস্তার মোড়।  যখন ডাইনে গেলে বাঘে খাবে, বাঁয়ে গেলে ভালুকে খাবে আর সোজা গেলে সোনা পাবে।  এই সব এক্সট্রিম মুহূর্তে নিজের আবেগকে ধরে রাখা, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া।  কেননা একটু ভুল যেটা আর সংশোধনের উপায় থাকে না। এই ব্যাপারে রাশিয়ানরা বলে মাইন্ পরিষ্কারকারীরা শুধু এক বারই ভুল করতে পারে। ছেলেমেয়েরা যখন জিজ্ঞেস করে "তাহলে কি আমরা শুধু এক্সট্রিম মুহূর্তেই তিন রাস্তার মোড়ে  দাঁড়াই?'  আমি বলি, "না, আমরা প্রতি মুহূর্তেই তিন রাস্তার মোড়ে  দাঁড়াই। অন্ততঃ জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে।  তা সে পেশা বাছাই করে হোক, বিয়ে করা  হোক, চাকরী করা হোক  বা অন্য যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই  হোক।  তবে সেখানে ডাইনে  গেলে বাঘে খাবে, বাঁয়ে গেলে ভালুকে খাবে আর সোজা গেলে অজগর খাবে। তার মানে এসব পথই  হবে দীর্ঘ, কণ্টকময়, আর প্রতিটি মুহূর্তে কাটা সরিয়েই সামনে এগুতে হবে, পৌঁছুতে হবে লক্ষ্যে।"

যাই হোক, মনে হয় ঘন্টা দেড়-দুই এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত আশার  আলো  দেখলাম।  কে যেন আমাদের নিতে এলো।  বাড়ী  ফিরে শুনলাম সবাই বহাল তবিয়তে আছে।  বাবাকে আর জ্যাঠামশায়কে নিয়ে মাখন কাকা পাশের পাড়ায়  চলে যেতে পেরেছিলো।  মা বেত আর অন্যান্য গাছের ঝোঁপে  গলা জলে দাঁড়িয়ে সময় কাটিয়ে দেয়। তপনদাও ছিল জলে ঘাপটি মেরে। সাতরানোর উপায় ছিল না, পাচ্ছে কেউ দেখে ফেলে।  কল্যাণদা ধরা পরে।  ও গেছিলো নৌকা বাইতে। তবে দূর থেকে আর্মি দেখে ও হাতে ঘড়িটা জলে ফেলে দেয় আর জলে ডুব দেবার  জন্য প্রস্তুত হয়, যখন আর্মিরা ওকে বন্দুকের মুখে বাড়ীতে  আসতে  বলে।  ও এলে  ওকে দিয়ে নদী  থেকে ঘড়ি তোলায় আর সেটা নিয়ে যায়।  কয়েকদিন আগে যখন ফোন কথা হলো, বললো, ও যখন ঘড়ি তুলতে ডুব দিচ্ছিলো, এক রাজাকার ওকে লক্ষ্য করে গুলী ছোড়ার  চেষ্টা করে, তবে সাথে থাকা আর্মি ওকে বিরত করে।

কল্যাণদার কাছেই জানা গেলো যে রাজাকারটা আর্মি  নিয়ে এসেছিলো আমাদের বাড়ী সে ছিল শশী বসাকের শ্যালক ছানা।  শশী বসাক তরার লোক, আমাদের মতোই বৈলতলা আশ্রয় নিয়েছিল। মাত্র কয়েক দিন আগে ও বেড়াতে এসেছিলো শশী বসাকের ওখানে, তখনই সব খোঁজ খবর নিয়ে গেছে। মনে হয়  ছানার আর্মি নিয়ে আসাটাই ছিল সবার কাছে সব চেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়, এটা কেউই আশা করেনি।

পরে দেখা গেলো বাড়ী  থেকে সব উধাও, যা পেয়েছে সব লুট করে নিয়ে চলে গেছে।  তখন সন্ধ্যা নেমেছে  - সবাই ক্ষুধার্ত। কি করা? তখন আমার মনে হলো পূজার জন্য আমি প্রতি দিনই একমুঠ করে চাল নিতাম, আর তা রেখে দিতাম  একটা বয়মে যেটা থাকতে চকির (বিছানা) তলায়।  দৌড়ে গিয়ে দেখি, ওটা জায়গা মতোই আছে।  ওই চালই  রাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হলো।  সে অর্থে আমার পূজাটা একেবারে ব্যর্থ হয়নি।

দুবনা, ১৪ নভেম্বর ২০১৬  


Saturday, November 12, 2016

১৭. তীরন্দাজ

দিন আসে দিন যায়, দিন কাটে খেলায় খেলায় আর কখনো বা পূজায়। ওই সময় আমার আরো একটা আগ্রহের জন্ম নেয়, সেটা হলো তীর-ধনুকের খেলা, যেটা পরে, প্রাইমারী  স্কুলের শেষ দিকে প্রকট আকার ধারণ করে।  পাটশলা বা পাট খড়ি দিয়ে বর্শা নিক্ষেপ নতুন কিছু ছিল না, বর্ষার সময় যখন নৌকা নৌকা পাট  আসতো  বাড়ীতে আর পচানোর পর খড়ি থেকে পাটের আঁশ আলাদা করা হতো, ঐ  খড়ি দিয়ে আমরা খেলতাম বর্শা নিক্ষেপ। কে কতদূর ছুড়তে পারে সেটাই মূল লক্ষ্য, তবে কখনো কখনো খড়ির মাথা মাটিতে গাঁথলো কিনা সেটাও দেখা হতো।  কখনো বা আবার বাঁশ  দিয়ে ধনুক তৈরী করে পাটশলার তীর ছুড়তাম আগে থেকে কোনো লক্ষ্য ঠিক করে। তবে একাত্তরে এই তীর-ধনুকের খেলা ছিল মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযোদ্ধা খেলা। 

আমার ছোট বেলা কেটেছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনে, যেখানে তীর-ধনুকের যুদ্ধ ছিল অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।  ছোট কাকা যখন রামের সেই তাড়কা  রাক্ষসী বধের গল্প শোনাতো আর বনভূমির উপর দিয়ে চিৎকার করে তাড়কা রাক্ষসীর আগমনী বার্তা শুনাতো এই বলে

হাউ মায়া কাউ
মানুষের গন্ধ পাও
ধরে ধরে খাও       

তখন সে কি ভয়, সে কি উত্তেজনা, যদি রাম  সময় মতো ধনুকে তীর জুড়তে না পারে। পরে আমিও ছেলেমেয়েদের এই গল্প বলতাম ওদের ছোট বেলায়।  আর সেই ছড়াটা পড়তাম এভাবে 

তি ফু উফ উখ  (Тьи фу уф ух)
চু-উঁ  চেলভেচিয়ে দুখ  (Чую человечье дух)
নিয়েত মিয়াছা ভকুসনেয়ে লুদেই (Нет мясо вкуснее людей)
লাভি ইখ ই ছিএস পস্কোরেই  (Лови их и съешь поскорей)

তখন মনিকা, ক্রিস্টিনা আর সেভার সে কি ভয় - ওরা  যে যার মতো দৌড়ে পালিয়ে যেত এদিক সেদিক।

হ্যা, আমি নিজেকে মনে মনে রাম  ভেবে এই খেলা খেলতাম, খেলতাম একা একাই।  প্রথমে পাটশলা  দিয়ে শুরু করলেও পরে বাঁশের  কঞ্চি ব্যবহার করতাম তীর হিসেবে।  পরে বড় হয়ে তীরের মাথায় মেটালিক কোণ  লাগিয়ে দিতাম। আমার যন্ত্রনায় কলা  আর পেঁপে গাছগুলোর প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি। 

এই তীর-ধনুকের শিক্ষা ছিল সজ্ঞাতভাবেই - শত্রু মোকাবিলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার অংশ। তখন মনে হয় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই এভাবে ভাবতো, অন্ততঃ  যাদের বড়বাড়ী  ফেলে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।  যুদ্ধের পরেও আমরা অনেক দিন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেছি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে। জানি না এখন দেশে এমন করে খেলে কিনা স্কুলের ছেলেমেয়েরা।  তবে সোভিয়েত দেশে দেখেছি যুদ্ধের কয়েক যুগ পরেও বাচ্চাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে জার্মানদের বিরুদ্ধে, যদিও সরকারী ও জনমানসে এরা  অনেক আগেই জার্মানদের বন্ধু হিসেবেই মেনে  নিয়েছে।    

আজ অনেক সময়ই নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, এই যে ছোট বেলায় এতো ঠাকুর দেবতা খেলতাম, এখন এসব আমাকে টানে না কেন? মনে ময় আমি তাদের কখনোই অন্যেরা যেভাবে দেখে সে ভাবে দেখিনি।  ওই রাম, ওই কালী - এরা ছিল আমার খেলার সাথী। যখন জীবন চলতে গিয়ে নতুন সাথীর, নতুন  পথের সন্ধান পেয়েছি - আমরা যার যার মতো সেই সেই পথে চলে গেছি।  ব্যক্তিগত জীবনে আমি "না" বলতে কখনো দ্বিধা করি না, কোনো ব্যাপারে দ্বিমত থাকলে তা সোজা জানিয়ে দেই, আবার কারো দ্বিমত অনায়াসে গ্রহণ করতে পারি।  তবে যখন দেখি বিশ্বাসগুলো ডগমার আকার নিয়েছে, যেখানে এক দিনের সহযাত্রীর আমার মতামত শোনার মতো আগ্রহ নেই, তখন চুপ করে সরে পড়ি।  এখানেও হয়তো সেটাই ঘটেছিলো।  তাছাড়া মানুষ ভগবানকে স্মরণ করে কিছু পাওয়ার জন্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের বা নিজের আপনজনদের জন্য প্রার্থনা করে, যদিও কখনো সখনো ঢাক ঢোল পিটিয়ে সারা বিশ্বের মঙ্গোল কামনা করতেও দেখা যায়।  আমার চাওয়াটা বরাবরই কম, আর সেটা মূলতঃ  কিভাবে নিজের জ্ঞানের সীমানা বাড়ানো যায়, নিজেকে মানসিক ভাবে উৎকর্ষ করে তোলা যায়, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  আমার ধারণা এটা আমি ভগবানের সাহায্য ছাড়াই করতে পারি। আমার বদলে এই সময়টা উনি অন্য কাউকে দিলে অনেক বেশী  কাজে দেবে।    

দেশের শেষ দিনগুলো কাটে বাম রাজনীতির চর্চায়। তবে আমার নিজেকে কখনো ধর্ম বিরোধী মনে হয়নি।  আসলে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ  দিয়েছি অনেক আগেই, কেননা ধর্ম বলতে মানুষ ফিলোসফি না বুঝিয়ে বিভিন্ন আচার আচরণ বুঝায়, আর ও নিয়ে ভেদাভেদ তৈরী করে। তার পরেও সোভিয়েত  ইউনিয়নে আসার পর মাঝে মধ্যেই চার্চে যেতাম আমার রুমমেট কুমারের সাথে। ভালো লাগতো।  পরে বিয়ে করার পর বাসায় আমিই ইস্টার আর ক্রিসমাস পালন করার উৎসাহ দেই - স্রেফ উৎসবের দৃষ্টি থেকে। 

দুবনায় কাজ করার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করতো আমি বিশ্বাসী কি না (বিশ্বাস করি কি না)? আমি বলতাম, তোমরা যে অর্থে কথাতা বলছ  সে অর্থে নয়।  আমি বিশ্বাস করি দুয়ে দুয়ে চার। বিশ্বাস করি আরো কিছু গাণিতিক এক্সিওম, আর তার উপর ভিত্তি করেই চলি জীবনের পথ। সব সময় প্রশ্ন করে, সব সময় অবিশ্বাস করে।  আমি বিশ্বাস করি বুদ্ধের সেই বাণী, সুখী হতে চাইলে চাহিদা (লোভ) সম্বরণ করো।  অথবা গীতার  সেই কথা, "কাজের আনন্দেই কাজ করে যাও।  ফলের চিন্তা করো না।  যদি কাজের মধ্যে আনন্দ পাও কাজটা  সঠিক ভাবে সম্পন্ন হবে, আর সেটা হলে আজ হোক, কাল হোক - ফল আসবেই আসবে।" জানি এটা আমার নিজস্ব ইন্টারপ্রিটেশন - তবে তাতে কিই  বা আসে যায়।

আমরা সব কিছুই বুঝি নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থেকে।  তার পরেও প্রত্যেকের নিজ নিজ ফিলোসফি থাকে, অন্ততঃ  প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের সেটা থাকে বলেই আমার বিশ্বাস। যাদের সেটা থাকে না, তারা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, অন্যের দেখানো পথে চলে সারা জীবন। এতে ভালো বা মন্দের কিছু নেই।  তবে যে পথ দেখাচ্ছে আর যেই পথ দেখাচ্ছে সেটা বিচার করার ক্ষমতা না থাকলে ভুল গন্তব্যে পৌঁছানো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে মার্ক্সবাদের কারণেই হোক বা রাশিয়ায় থাকার কারণেই হোক ধর্ম নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না।  পরে মনিকা যখন চার্চে যেতে শুরু করে, আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে আসলে বলতাম "ঈশ্বরকে শুভেচ্ছা দিস।" প্রথমে  একটু ইতস্ততঃ করলেও পরে সয়ে গেছিলো ওর। ২০০৫ সালে দেশ থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন দুবনায়। দুপুরে খাচ্ছিলাম সবাই, আমাদের ডাইরেক্টর আরো অনেকে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন ঈশ্বর নিয়ে আমার ভাবনা কি?

- ঈশ্বর আমার বন্ধু।  আমরা একে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাই না। 
- কিন্তু ঈশ্বর তো কারো বন্ধু হতে পারেন না।
- এটা  ঈশ্বরের সমস্যা, আমার নয়।

তার পর এই প্রশ্নে ফিরে আসি অনেক দিন পরে, যখন অনেকেই এসব নিয়ে লিখতে শুরু করে।  তবে আমি নিজেকে কখনোই না আস্তিকের না নাস্তিকের দলে মেলাতে পেরেছি।  আমি কাউকে ডাকি না, একলা চলি।  কেননা এর মধ্যে জেনে গেছি, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা  চলতে হয়।  তবে ইদানিং এ নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলি,

এই দেখো, তোমার হাতে যে সেল ফোনটা আছে ওটা কে আবিষ্কার করল সেটা জানলে কোনো ক্ষতি নেই, তবে ফোনটা  কিভাবে কাজ করে সেটা না জানলে আবিষ্কারকের নাম তোমার কোনো কাজেই লাগবে না।  এখন কর্ম সূত্রে আমি এই মহাবিশ্ব কিভাবে তৈরী হলো, কিভাবে চলছে আর কিভাবে বিবর্তিত হচ্ছে এ নিয়ে গবেষণা করছি।  এই রহস্য আমরা যদি জানতে পারি, সেটা মানব জাতির অনেক বেশী  কাজে লাগবে। আর এসব জানার পর যদি সময় থাকে তখন না হয় বিশ্বব্রম্মান্ড কে সৃষ্টি করলো সেটা নিয়ে গবেষণা করা যাবে। কথাটা হয়তো খুব সরলীকরণ, তার পরেও কোনো বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে এভাবে বলতে বা ভাবতে ভালো লাগে।

কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। কেন কিছু মানুষ ধর্মের (ঈশ্বরের) শরণাপন্ন হচ্ছে আর কিছু মানুষ দিন দিন ধর্ম (ঈশ্বর) থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্যদের কথা জানি না, তবে আমার মনে হয় একাত্তর প্রথমে পাকিস্তানের শোষণ হতে বাংলাদেশকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মুক্ত করার জন্য হলেও পাকিস্তানী শাসক আর তাদের দেশীয় দোসররা এটাকে অনেকাংশেই হিন্দুবিরোধী আর ভারত বিরোধী যুদ্ধ হিসেবে দাঁড় করতে সফল হয়েছিল। আমাদের এলাকায় তাই মূলতঃ  হিন্দুরাই আক্রান্ত হয়েছিল, হয়েছিল গৃহছাড়া। বন্ধুদের অনেকেই ওই সময় দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, যাদের দেখা আর কখনো মেলেনি। এটা হয়তো আমাকে ধর্মের প্রতি বিমুখ করে তুলেছিল।  স্বাধীনতার পর যদিও কয়েক বছর ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় থাকে, বাহ্যিক ভাবে হলেও সংখ্যালঘুরা মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ পায় দেশে, পঁচাত্তরে পট পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আবার মাথা চারা  দিয়ে ওঠে।  হয়তো বা ধর্মকে এই ভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার কারণেই ধর্মের প্রতি জেগেছে অনীহা ঠিক যেমনটা পলপট, মাও  সে তুং  বা ষ্টালিনের নিপীড়নমূলক রাজনীতি সমাজতন্ত্রের প্রতি অনেককেই বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে।

এতো কিছুর পরেও একাত্তরে তীর-ধনুক নিয়ে খেলা, নিজেকে শত্রুর মোকাবিলায় তৈরী করা বৃথা যায় নি।  ওই খেলাটা শিখিয়েছে শত্রুদের মোকাবিলা করতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে।  একারণেই হয়তো আজও যখন প্যালেষ্টাইন, সিরিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিংবা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক কারণে কাউকে হত্যা করতে দেখি, প্রতিবাদে চিৎকার করে ওঠে হৃদয়, ওদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছুটে  যায় মন। একেই হয়তো বলে একাত্তরের চেতনা।

মস্কো, ১২ নভেম্বর ২০১৬      
            


Thursday, November 10, 2016

১৬. পূজা

জল আর জল, চারিদিকে শুধুই জল।  এই সীমাহীন জলের মধ্যে মাঝে মধ্যে দ্বীপের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে বিচ্ছিন্ন কিছু বাড়ী। সেই দাড়িয়াবাঁধা খেলার মাঠ, বইরাগীর  চক  সব কিছুই হারিয়ে গেছে জলের নীচে। স্থলের গন্ডী  যতই ছোট হয়ে আসছে, জীবনের চলার  পথও  ততই সীমিত হয়ে পড়ছে।  শুধু মাত্র যারা স্বপ্ন দেখতে পারে, তারাই মনে মনে হাটতে পারছে দূরের কোনো নক্ষত্রে বা গ্যালাক্সিতে। আর তারার উপর পা ঝুঁলিয়ে বসে উঁকি দিয়ে দেখছে নীচের এই ডুবে যাওয়া পৃথিবীকে যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে খড়কুটা ধরে হলেও ভেসে থাকতে, বেঁচে থাকতে।

বাঁচার তাগিদে, যুদ্ধকে ক্ষনিকের জন্য হলেও ভুলে থাকার তাগিদে একটু একটু করে শুরু করা সুতার ব্যবসা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে।  রঙের কাজ কুদ্দুস  ভাইয়ের ওখান থেকে চলে এসেছি বৈলতলায়। বাড়ীতে আমাদের খেলার জায়গাগুলো দখল করেছে বাঁশের  আর।  আর - এটা অনেকটা জাংলার  মতো,  মাটি থেকে হাত দুই উপরে পরস্পর থেকে হাত দশেক দূরে সমান্তরাল ভাবে দুটো বাঁশ  বাঁধা খোটার উপর - অনেকটা ঝুলন্ত রেল লাইনের মত। এই দুই বাঁশের উপর আড়াআড়ি পাতা অনেক গুলো বাঁশ যেখানে শুকানো হয় রঙিন সুতা।

কিছুটা সময় কাটে সুতা উল্টিয়ে, যাতে তা তাড়াতাড়ি শুকায়।  কখনো বা মদন মিস্ত্রীর ওখানে গিয়ে ষাট  ধরি আর হাতুরি -বাটাল নিয়ে খেলি।  তবে এসবই  হয়, যেদিন সূর্য্য আসে আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে।  কিন্তু যেদিন আকাশ ভেঙে পরে অবিরাম কান্নায় সেদিন আমার সময় কাটে ঘরের সামনে যে ছোট বারান্দা আছে, ওখানে বসে।  একা  একা মার্বেল খেলে।  মনে হয় একা  থাকার অভ্যেসটা আমি ওখান থেকেই রপ্ত করেছি।  আর এই রপ্তটা  এতো ভালো করে করেছি যে এখনো খুব বেশি সময় মানুষের সাথে থাকতে পারি না।  যদি শারীরিক ভাবে  একা  থাকার সুযোগ না হয়, হারিয়ে যাই বইয়ের মধ্যে বা লেখায়। কখনো বা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে শুরু করি।  সবাই ভাবে ছবি তুলছি, আর আমি যতটা না ছবি তুলি, তার চেয়েও বেশি করে হারিয়ে যাই নিজের মধ্যে।

যখন খেলতে খেলতে ক্লান্ত বা বিরক্ত, শুরু হতো পূজা।  এটাও এক প্রকার খেলা, পূজা পূজা খেলা।  তখন ছোট ছিলাম, ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস ছিল। আমি কলার ডগা  দিয়ে ঠাকুর বানিয়ে খেলতাম। কলার পাতা সরিয়ে ফেললে যে ডগা  পাওয়া যায়, তার এক দিকটা কাটতাম সোজা, অন্যটা কোনাকুনি।  ওই কোনাকুনি কাটা দিকটা হতো মুকুট পড়া মাথা। একটু নীচে ছোট্ট একটু ছিদ্র করে ঢুকিয়ে দিতাম ডগার  উপরের ছোট এক টুকরা  ছাল বা বাঁকল,  ওটা হতো গিয়ে জিহ্বা। আরো একটু নীচে , যেখানে হাত থাকার কথা ওখানে আড়াআড়ি ছিদ্র করে ঢুকিয়ে দিতাম আরো দুটো ছাল, যা ছিল দেবীর চার হাত।  এভাবেই তৈরী হতো কালীর  মূর্তি। আরো তিন চার টুকরা কলার ডগা নারকেলের শলা  দিয়ে গেথে তৈরী  করতাম কাঠাম, আর আরো একটা শলা  দিয়ে মূর্তিটা বসিয়ে দিতাম কাঠামের উপর।  আমার যন্ত্রনায় বাড়িতে শলা  বা বারুন  আস্ত  রাখা কঠিন ছিল। এ নিয়ে  প্রায়ই মায়ের বকা শুনতে হতো।

পূজা আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না।  বাড়ীতে  তিন বেলা গৃহ দেবতার পূজা হতো। অনেক সময় মা-মেঝমারা  ব্যস্ত থাকলে বা কাপড় বদলাতে আলসেমী  হলে আমাকে বলতো পূজা করতে।  আমি জামাকাপড় খুলে বসে পড়তাম পূজা করতে।  আমি  সব সময় দেবতাদের বেশী  করে বাতাসা, কদমা আর সন্দেশ দিতাম।  আমি অনেক আগেই বুঝে গেছিলাম, শেষমেষ  আমি নিজেই এগুলো খাবো। এই যে তিন বেলায় দেবতাদের খাওয়ানো, রাতে ঘুম পাড়ানো আর সকালে ঘুম থেকে তোলা  - সবই ছিল জীবনের অংশ, অনেকটা খেলার মতো।  পরে যখন নিজের মেয়েরা একটু বড় হয়, ওদের হাতে বারবি বা ওই জাতীয় পুতুল পরে,  আমার বৌ সব কাজ বাদ  দিয়ে পুতুলদের জন্য জামা-কাপড় সেলাই করতো। ওর সেলাইয়ের উপর কলেজের ডিগ্রীটা ঐ একটা কাজেই লেগেছিলো।  আমিও কখনো নিজে, কখনো কাজে যে সব মিস্ত্রীরা  আছে ওদের বলে কাঠ দিয়ে চেয়ার, টেবিল, খাট - কত কিছুই না তৈরী করে দিতাম।  এটাও মনে হয় সেই একাত্তরের উত্তরাধিকার।

যদিও অনেক আগেই ঠাকুর দেবতা আর  আমার  পথ দুটি দিকে বেঁকে গেছে, এখনো ঐসব দিনের কথা মনে পড়লে  ভালোই লাগে।  পূজা-পার্বন মানেই অনেক রকমের খাবার, বাড়ী  ভরা আত্মীয়-স্বজন।  ঢাক, ঢোল, শঙ্খধ্বনি, মায়েদের উলুধ্বনি - এক কথায়  অনাবিল আনন্দ।  তাছাড়া আমাদের যেটুকু ধর্ম শেখ বা করা, সেটা ওই রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনেই, যেখানে দেবতা-দানব আর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। যেখানে এরা  সবাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা শক্তির পূজারী। নিজেরাই যুদ্ধ করছে - কখনো ন্যায়, কখনো অন্যায় যুদ্ধ, আর এই যুদ্ধে সব সময়ই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হচ্ছে।  এখন যদিও রামকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে বলায়  বা বনবাস দেয়ায়, আমার কাছে এখনো পরিষ্কার নয়, রাম  আসলে কি - নারী বিরোধী না প্রজা বৎসল? তার চেয়েও বড় কথা সেখানে কোনো বিধর্মী ছিল না, তাই অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ গড়ে উঠতে পারে নি।  কে জানে, রামায়ণ-মহাভারত যদি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পরে লেখা হতো, তাহলে এই দুই মহাকাব্য তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারতো কিনা?

তখন কি ঈশ্বরে বিশেষ করতাম? হয়তো বা।  আসলে মানুষ খুবই অসহায়।  শুধু মাত্র পাশের বাড়ীর  সংখ্যালঘু বা শিশু বা নারীদের সামনে সে দানবের মতো শক্তিশালী।  কিন্তু একটা ঝড় উঠুক, অমনি লেজ গুটিয়ে ভগবানের পায়ে নিজেকে সপে দেয় সে।  আমরা শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। মানুষ যখন নিজে বিপদের মোকাবিলা  করতে পারে না বা করতে চায়না,  তখনই সাহায্য চায় তার চেয়েও বড় কারো।  ছোট বেলায় বড় ভাই বা বাবা তার পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু সমস্যা বড় হলে? সে তখন আশ্রয় নেয় বড় শক্তির কাছে।  যারা ভগবানে বিশ্বাস করে, তারা নিশ্চিন্ত মনে নিজের সমস্ত সমস্যা তার কাঁধে তুলে দিয়ে শান্তি পায়। আর আমি? এক সময় যখন দেখলাম বাবা আর সব সময় আমার পাশে দাঁড়াতে পারছে না, আমি হাটলাম উল্টো পথে।  পরে বাবা মারা যাবার পর, এখন কোনো প্রশ্ন জাগলে বাবাকেই স্মরণ করি, মনে মনে কথা বলি, কারণ জানি বাবা কখনোই আমার খারাপ চায় না।  এটা আসলে নিজের সাথেই সংলাপ।

মাঝে খানে দেবতাদের নিয়ে কোনো মাথা ঘামাতাম না।  তবে ইদানিং কালে যখন দেবতাদের ঘর পুড়তে দেখি, দেখি দেবতাদের ঘর ছাড়া হয়ে যেতে, অথবা কোনো দেবতার ছিন্ন মস্তক ভুলুন্ঠিত হয়ে থাকতে, খুব মায়া হয় ওদের জন্য।  ভালো কতটুকু করেছে জানি না, তবে কারো ক্ষতি তো ওরা করে নি।  তার পরেও কতই  না নাজেহাল হতে হয় ওদের, আর সেই সব মানুষদের যারা সব কিছুর পরেও এই দেবতাদের আঁকড়ে থাকে,  দেবতার অসীম করুনায় আর শক্তিতে বিশ্বাস করে।  একাত্তরেও এমন হতো, আজও  হয়।  ক্যালেন্ডারের পাতা ঝরে পরে, দেশের নাম বদলায়,  বদলায় দেশের চেহারা, কিন্তু মানুষ বদলায় না।


দুবনা, ১১ নভেম্বর ২০১৬