এবার যখন দেশে আসি মস্কো বসেই প্ল্যান করেছিলাম একাত্তরে পালিয়ে কাটানো ওই গ্রামগুলো দেখতে যাবো। তাই ২৮ নভেম্বর যখন বাড়ি এলাম, পরের দিনই মানিকগঞ্জ গিয়ে দেখা করলাম বাসেতের সাথে। বাসেত কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে, এখন ওকালতি করে মানিকগঞ্জ। দেখে খুব খুশি হলো। তবে মনে হয় আমরা যতটা না নিজেদের চিনি তার চেয়ে বেশী চিনি আমাদের বাবাদের। আর আমাদের চেনা বা জানা - মানেই বাবাদের কাছে শুনে চেনা। ওরা আমার কাছে যতটা না রাশেদ-বাসেত, তার চেয়েও বেশী কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে, ঠিক তেমনটাই আমিও হয়তো ওর কাছে বৃন্দাবন সাহার ছেলে। তাই হয়তো কথায় কথায় বললো, "বাবা বলতো, আমি জীবনে বৃন্দাবন সাহার বাড়ী ছাড়া কোনো হিন্দু বাড়ী খাই নাই, কিন্তু ওই বাড়ীতে খেতে বসে মনে হয়েছে, যেন নিজের বাড়ীতেই খাচ্ছি। " আসলে এমনটাই হয়, মানুষ যখন একে অন্যকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, তখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ সব দূরে সরে যায়, সব কিছু ছাপিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায় শুধুই ওই মানুষটা - ভালোবাসার বা শ্রদ্ধা করার অথবা ঘৃণা করার। ওর কাছ থেকেই এলাকার কমবেশী খোঁজ খবর নিয়ে ঠিক করলাম, কয়েক দিনের মধ্যেই যাবো বাঙ্গালা আর ওখান থেকে বৈলতলা। ও বার বার বলে দিলো আমরা যেন অবশ্যই ওদের বাড়ী যাই আর যাবার আগে ওর ভাই রাশেদকে টেলিফোন করি, নইলে খুব মাইন্ড করবে।
৫ই ডিসেম্বর বারোটার দিকে বেরুলাম বাঙ্গালার পথে। প্রথমে ভেবেছিলাম ট্রলারে করে প্রথমে বৈলতলা যাবো, ওখান থেকে পরে যাবো বাঙ্গালা। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো জলের অকাল, তাই ট্রলারে গেলে হাটতে হবে অনেকটা পথ, আবার একাত্তরের মতোই মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যেতে হবে ওদিকটায়। তাই ঠিক হলো, প্রথমে বাসে করে করে যাবো ঘিওর, ওখান থেকে হ্যালো বাইকে প্রথমে বাঙ্গালা আর তার পর বৈলতলা। তবে বাস ফেল করায় ঘিওর গেলাম সি এন জিতে সারা রাস্তা ঝাকুনি খেতে খেতে। মাইল্যাগী দিয়ে যাবার সময় মনে করলাম কোথায়, কোন বাড়িতে ছিলাম আমরা।
ঘিওর থেকে হ্যালো বাইকে করে রওনা হলাম বাঙ্গালার দিকে। প্যাসেঞ্জাররাই বলে দিলো ওখান থেকে কিভাবে বৈলতলা যাওয়া যায়। কথায় কথায় জানালাম আমাদের আসার উদ্দেশ্য, জানলাম কি কি পরিবর্তন হয়েছে এলাকায়। ওখানেই ধামসরের একজনকে পাওয়া গেলো। ওনার কাছ থেকে জেনে নিলাম ওই এলাকার খবর। গল্প করতে করতে ঘিওর থেকে আমরা এসে পৌছুলাম বাঙ্গালায়।
হ্যালো বাইক থেকে নেমে দেখি কে যেন একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চিনতে কষ্ট হলো না। কুদ্দুস ভাইকে মনে করিয়ে দিলো। ও রাশেদ, খবর পেয়ে এসেছে আমাদের নিয়ে যেতে। হাটতে হাটতে চললাম ওর পেছন পেছন। নতুন রাস্তা চলে গেছে বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে। ফলে একদা যেখানে ছিল সবুজ মাঠ এখন সেখানে ডোবা আর ডোবা, বলা যেতে পারে খাল, তবে তা জাল দিয়ে ভাগ করা যেমনটা আল দিয়ে ভাগ করা থাকে মানুষের জমি। ডোবাগুলো জলে ভর্তি, এখানে সেখানে ভাসছে পানা আর তার নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো কালো মাছ। এখন আর এখানে ফসল চাষ হচ্ছে না, হচ্ছে মাছের চাষ।
দেখতে দেখতে চলে এলাম শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ীর সামনে। মনে পরে গেলো সেই মাইট্যালটার কথা। ওটা আজ আর আগের মতো নেই, আশেপাশের ডোবাগুলোর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক চাচা। রাশেদই আলাপ করিয়ে দিলো। উনি এখন এই বাড়ীর মালিক। বললাম, একাত্তরে আমরা এ বাড়িতে ছিলাম। আমাদের ডাকলেন, বেরিয়ে যেতে বললেন। সময় ছিল না। তা ছাড়া বাইরে থেকেই দেখলাম, বাড়ীর শুধু মালিকানায় পরিবর্তন হয় নি, বাড়ীর ঘরগুলোর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। স্মৃতিতো শুধু মাটি নয়, সেখানকার মানুষ, ঘরদোর আরো কত কিছু। তাই আর ওখানটায় যেতে ইচ্ছে করলো না। চললাম সামনের দিকে। আগে, একাত্তরে শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ীর সামনে ছিল মাঠ আর মাঠ - এখন অনেক নতুন বাড়ীঘর উঠে গেছে। যদিও আমার নিজের গ্রাম তরায় ঘরে ঘরে ভোরে গেছে মাঠ ঘাট, তবুও এই বাঙ্গালায় সেটা দেখে অবাকই লাগলো। অবাক হয়ে দেখলাম জমির ধার দিয়ে চলে যাওয়া সেই রাস্তাটা মাটি চাপা পড়েছে। এখানেও উন্নতির জোয়ার - নতুন রাস্তা নতুন জীবন। তবে পাশে হেটে যেতে যেতে কে যেন বললো, আগের রাস্তাই ভালো ছিল, নিচু, কিনতু সমান। এখন রাস্তা উঁচু করেছে ঠিকই, তবে এখানে গর্ত তো ওখানে উঁচু মাটির ঢিবি। আসলে উন্নয়নের ব্যাপারটাই, খুবই অসমান, বিশেষ করে আমাদের মত দেশে - কেউ কেউ উন্নতির শিখরে বসে থাকলেও অধিকাংশই পরে থাকে কানাগলিতে। জীবন চলার পথে প্রায়ই হোঁচট খায়, যেমনটা এখানকার মানুষ রাত বিরাতে হোঁচট খায় এই উঁচু কিন্তু অসমান পথে।
অবাক হলাম দেখে যে গ্রামের বাজারটা শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ী থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরে। ওই সময় মনে হতো বাজারটা যেন দিগন্ত পেরিয়ে। মনে হয় পাগুলো আমার তখন খুব ছোট ছিল আর ছোট ছিল পদক্ষেপগুলো। বাজারটা অনেকটা আগের মতোই আছে, তবে ওই দিন, মানে সোমবার হাট ছিল বলে ধীরে ধীরে লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে।
আরো অনেকটা পথ পেরিয়ে রাশেদ নিয়ে এলো আমাদের ওদের বাড়ীতে। আগে শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ী থেকে মাত্র কয়েকটা বাড়ী পেরুলেই চলে যাওয়া যেত ওদের ওখানে, এখন উঁচু রাস্তা ধরে যেতে যেতে পার হয়ে এলাম প্রায় এক কিলোমিটার পথ। শহরে উন্নয়ন এনেছে যানজট, গ্রামে ঘোরা পথ।
কুদ্দুস ভাইদের পুরানো বাড়ীটা সরে এসেছে নতুন জায়গায়, পাশেই। ওই সময়ের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয় সেই তাল গাছ আর গাব গাছ। রশিদের এখনো মনে আছে, ওই আবার মনে করিয়ে দিলো, দেখালো গাছগুলো। তবে বড় বড় সেই আম গাছগুলো আর নেই, যেমনটা নেই বাজারের সেই বট গাছটা। ওই সময় কুদ্দুস ভাইয়ের বাড়ীর পেছনে দাঁড়িয়ে তেরশ্রী পর্যন্ত দেখা যেত, এখন অনেক নতুন বাড়ীঘর আটকে দেয় দৃষ্টিকে।
আমার সব সময়ই খালেক নামটা মনে পড়ছিলো, তবে বাড়ীর কারোই মনে ছিল না। রশিদ আসলো সাহায্যের হাত নিয়ে। খালেক ছিল কামাক্ষার বনধু যে হরহামেশা গান বাঁধতো। রাশেদের ছেলেমেয়েরা কেউই আর গ্রামে থেকে না, ওরা দুজনেই এখন এখানকার বাসিন্দা। আদর করে দই আর মিষ্টি খাওয়ালো - তেরশ্রীর দই মিষ্টি, যা এলাকায় খুবই নাম করা। ও হয়তো ভেবেছে আমরা ওর ওখানে ভাত খাবো না, তাই এই ব্যবস্থা। দিন পাল্টে গেছে, আমরা এখন সব জায়গাতেই খাই।
অনেক গল্প করলো রাশেদ। পুরানো প্রতিবেশীদের গল্প। কামাক্ষা, রাম মামা, বাদল দা আরো কত নাম।
- সেই দিন আর নাই কাকা। সেই মানুষও নাই। আশেপাশের যে সব হিন্দু বাড়ী ছিল, অনেক আগেই চলে গেছে। এসেছে নতুন মানুষ, কিনতু তাতে পরিবেশ ভালো হয় নাই। এখনতো পাহারা ছাড়া ঘুমানোই যায় না। আজ চোর আসে তো কাল ডাকাত। পাহারা দিতে হয় রাত জেগে।
- কেন? এখন তো রাস্তাঘাট কত উন্নত হয়েছে, চাইলেই ঘিওর যেতে পারো ২০ মিনিটে। কারেন্ট, দোকানপাট, মোবাইল ফোন ...
- এগুলোর দরকার আছে ঠিকই, তবে মনে শান্তি দরকার, স্বস্তি দরকার। মানুষ দরকার, যাদের কাছে যাওয়া যায়, যাদের সাথে কথা বলা যায়। ওই মানুষ এখন কোথায় পাবো কাকা?
আমারও তাই মনে হয়, দেশের উন্নতি কেন যেন শুধু অর্থনৈতিক সেক্টরেই আটকে গেছে। অনেকটা নিত্যতার সূত্র ধরে সেই সাথে শিক্ষা (একাডেমিক শিক্ষা নয়) , সংস্কৃতি, নৈতিকতা এসব ব্যাপারে আমরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছি। যে ভাষা আর সংস্কৃতির জন্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, আজ আমরা একটু একটু করে সেই ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। অবশ্য হতে পারে এটা আমার দেখার ভুল। হয়তো তাই কেউ কেউ মনে করে যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চমৎকার স্মৃতিচারন বিষয়ক আমার লেখাগুলো অত্যন্ত উপভোগ্য হলেও গল্পের শেষে, কিছু বিমূর্ত বিষয় দাড় করিয়ে আমি নাকি ঢালাও ভাবে নিজের (?) সমাজ-জাতি তথা দেশের ওপর সাম্প্রদায়িকতার তকমা এটে দেই যা কোন বিজ্ঞানের মাঝেই পরেনা।
আমার অবশ্য তেমনটা মনে হয়না। একাত্তরকে নিয়ে লিখতে হলে শুধু যে সেই টাইম-ফ্রেমের মধ্যেই থাকতে হবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। তছাড়া আমি ইতিহাস লিখছি না, লিখছি সেই সময়ে ও আমার পরবর্তী চিন্তা ভাবনায় একাত্তরের প্রভাব, একাত্তরের ঘটনাবলীর প্রভাবের কথা। বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হবার ফলে আমি ভালো বা মন্দ সব জিনিষকে প্রশ্ন করেই গ্রহণ করি। হতে পারে সব সময় আমার সিদ্ধান্ত সঠিক না, বা অন্যদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়, তবে তার পরেও ওই সত্য বা মিথ্যা আমার একান্তই নিজের, নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার বিচারে গৃহীত। যদি আমি সেটা না করে অন্যদের কথায় কোনো কিছুকে সত্য বা মিথ্যা বলে গ্রহণ করতাম, তা হতো তাদের সত্য বা মিথ্যা - যার প্রতি আমার থাকতো শুধুই বিশ্বাস, যুক্তি নয়।
যদিও হাটছিলাম আমি বাঙ্গালার রাস্তায় ২০১৬ সনের ৫ ই ডিসেম্বর, আমি যেন তখন অবস্থান করছিলাম সমান্তরাল বাস্তবতায় - বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম ফেলে আসা সেই একাত্তরে। এই নতুন বাস্তবতা দুহাতে সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো একাত্তরের সেই বাঙ্গালা, যেখানে কুদ্দুস ভাই, শশী জ্যাঠামশায়, রাম মামা, কামাক্ষা, আরো অনেক অনেক মুখ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো।
তরা, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬
Sunday, December 11, 2016
Sunday, December 4, 2016
২৭ অসুস্থ অসাম্প্রদায়িকতা
ঠিক মনে নেই কবে, তবে একাত্তরের ওই দিনগুলোতেই একদিন বড় মামা বেড়াতে এলো বৈলতলায়। বড় মামা - আমার মার জ্যাঠাতো ভাই - মাদের ভাই-বোনদের মধ্যে সব থেকে বড়। মামা থাকতো মির্জাপুর। বড় মামা মার দিক থেকে আমাদের একমাত্র ঘনিষ্ট আত্মীয় যে দেশ ভাগের পর পাকিস্তানে রয়ে গেছিলো। আমার বাবা-কাকারা কেউই প্যান্ট-শার্ট পড়তো না, ধুতি-পাঞ্জাবী পরেই সারাজীবন কাটিয়ে দিলো। মামা চাকরী করতো থানার কৃষি ডিপার্টমেন্টে, তাই প্যান্ট-শার্ট পড়তো। সব সময়ই ফিটফাট থাকতো। সিগারেট খেত প্রচুর আর চা। তবে আমাদের চা খাওয়াতে আপত্তি করতো না। বড় মামার বাবা, মানে মার জ্যাঠা ছিল ঠিক উল্টো। উনি থাকতেন পশ্চিবঙ্গের গুপ্তিপাড়া। যদি কলকাতা থেকে আমরা হাওড়া স্টেশন হয়ে বহরমপুর মাসীর বাড়ী যেতাম, বুঝতাম, পথে গুপ্তিপাড়া নামবো, আর শিয়ালদহ থেকে যাওয়া মানে সোজা মাসির ওখানে। সেক্ষেত্রে উল্টো পথে আমরা গুপ্তিপাড়া যেতাম। ওই যাওয়াটা আমার জন্য সব সময়ই ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ, কেননা যতদিন নিজেকে মনে পরে, চা ছাড়া আমি নিজের সকাল-বিকাল কল্পনাই করতে পারিনা। চা আমার জন্যঅনেকটা জীয়ন কাঠির মতো। দাদু বাচ্চাদের চা খাওয়া একেবারেই বরদাস্ত করতো না, সকালে উঠে বড়রা যখন চা খেতো আমাদের ভাগ্যে জুটতো হরলিক্স। মনে পরে, মা তখন আমাকে দাদুর সামনে হরলিক্স দিয়ে পরে গোপনে দেয়ালের বাইরে চা নিয়ে আসতো। অন্য সব দিকে দাদু ছিল খুব ভালো মানুষ। হাসি-খুশী। আর বড় মামা ছিলো গম্ভীর প্রকৃতির। এমনকি যুদ্ধের আগেও আমাদের বাড়ী খুব বেশি একটা আসতো না, তাই এই মামাকে হঠাৎ করে বৈলতলা দেখে অবাকই হই।
মামা যখন এলেন, যুদ্ধ চলছে পুরাদমে। প্রায়ই দেখতাম বাবা-কাকা আর জ্যাঠামশাইয়ের সাথে বসে কথা বলতেন যুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। অনেক সময় মা-মেঝমারাও আলোচনায় অংশ নিতো। সবারই মনে প্রশ্ন এইযুদ্ধ নিয়ে, এড়ানো যেত কিনা এই যুদ্ধ? বেশি দিন আগের কথা নয়, সবে মাত্র দেশ ভাগ হয়েছে, লাখো মানুষের রক্তের বন্যায় নেয়ে জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান - দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে। আর এর যাঁতাকলে পিঁষে মরেছে দুদেশেরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। স্বাধীন পাকিস্তানেও ওই প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বিভিন্ন অজুহাতে দেশ ছাড়তে হয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের। এমনকি যুদ্ধের সময় হিন্দুরাই মূলতঃ হয়েছে আক্রমণের শিকার। তাই অনেক সময়ই বড়দের কথায় বার্তায় প্রশ্ন এসেছে, অবশ্যম্ভাবী ছিল কি ভারত বিভাগ? অনেকের ধারণা এটা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। মাসুদের ভাষায়
"আমাদের উপমহাদেশ কোনসময়ই একটা দেশের মতো ছিলো না। ছিল উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্য, যা সবচেয়ে বেশী বিস্তার পেয়েছিলো মৌর্য, গুপ্ত আর ব্রিটিশদের সময়ে। তাদের সবারই ছিল বিভিন্ন কৌশল সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা। আর ব্রিটিশরা যেহেতু সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবচেয়ে বেশী ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। তাদের কাছ থেকে ভালো খারাপ মিলিয়ে অনেক নতুন কিছু ও পেয়েছি। আর ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগের বীজ বুনা হয়েছিলো সিপাহী আন্দোলনের সময়। .............."
এভাবে অনেকেই ভাবেন আর যেহেতু দেশটা ভাগ হয়েই গেছে, তাই এর অবশ্যকীয়তা বা অনিবার্যতা নিয়ে প্রশ্নটা বেমানান। তবে আমি যেহেতু সমাজবিজ্ঞানী নই, পদার্থবিদ, তাই ওই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই ব্যাপারটা দেখবো আর দেখবো যতটা না ভারত বিভাগ, তার চেয়েও বেশী করে ওই বিভক্তির মধ্যেই যে স্বাধীন বাংলার বীজ নিহিত ছিল সে ব্যাপারটা।
ভারত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ বা রাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত হলেও সব সময় তার এক আলাদা আইডেন্টিটি ছিল, যেমনটা আছে ইউরোপের। যদিও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজবংশ ভারতকে তাদের শাষণে এনেছেন, তা মূলতঃ ছিল রাজনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি মূলতঃ করদানের মধ্যেই সীমিত ছিল। ব্রিটিশরাই প্রথমে সারা ভারতকে একটা একক অর্থনৈতিক কাঠামোতে নিয়ে আসে। মুম্বাই, কলকাতা আর চেন্নাইয়ের মতো বড় বড় শহর স্থাপনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে ওতপ্রোতভাবে বেঁধে ফেলে। আর এই বন্ধন ধর্মীয় বন্ধন থেকে অনেক কঠিন। তাই অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভরতের টিকে থাকা ছিল একক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে রাখার থেকে অনেক কঠিন। এছাড়া একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার। যেকোন জিনিষই একে অন্যের সাথে জড়িত থাকে পাস্পরিক প্রতিবেশী এলাকাগুলোর মাধ্যমে। পায়ের সাথে যেমন মাথার যোগাযোগের জন্য শরীরের অন্যান্য অংশগুলোর দরকার, দেশের ক্ষেত্রেও তাই। একটু খেয়াল করলে দেখবো, চিটাগংয়ের ভাষার সাথে রোহিঙ্গাদের ভাষার অনেক মিল, একই ভাবে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার লোকদের কথা-বার্তা চলন-বলন পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার লোকজনের সাথে খুব বেশী করে মিলে যায়। একই কথা খাটে প্রতিটি অঞ্চলের ক্ষেত্রেই। এই ভাষাগত, ব্যবহারগত মিলগুলো এক ধরণের আঠা হিসেবে কাজ করে এক বৃহত্তর গোষ্ঠীকে একসাথে ধরে রাখতে। তাই ভারত ভেঙে পাকিস্তান যখন তৈরী হয়, এর দুই অংশের মধ্যের সেই আঠা উবে যায়। দুটো মানুষের সম্পর্ক যেমন শুধুমাত্র একটা জিনিসের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে পারে না (সে সম্পর্কটা হয় বিজনেজ সম্পর্ক) ঠিক তেমনিভাবে শুধু মাত্র ধর্মের উপর নির্ভর করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো জনগোষ্ঠী একই রাজনৈতিক পতাকায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। তাই ধর্মের ভিত্তিতে দেশ যখন ভাগ হলো, দ্বিজাতি তত্ব তখন তার আকর্ষণ হারালো পাকিস্তানের ভেতর। ওই তত্ব বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে এফেকটিভ হলেও, সমাজ গঠনে একই ভাবে কাজে লাগে না। তাই বিভিন্ন সময়ে ভারতবিরোধী শ্লোগান তুলে, সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধের মহড়া দিয়ে কিছুদিনের জন্য দেশভাগকে ঠেকিয়ে রাখা গেলেও বাংলাদেশের জন্মটা ছিলো অবশ্যম্ভাবী। তাই আমার মনে হয় বাবা-কাকা-মামাদের আলাপে যে দেশভাগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কারণ হিসেবে উঠে এসেছিলো, ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
তাই স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন, যেটা গড়ে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে, তা ছিল দ্বিজাতি তত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ধর্মীয় পরিচয়টাই আমাদের সার্বিক মিলনে এক বাধার সৃষ্টি করেছিল, এক জাতি, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির ধারক হওয়া সত্যেও আমাদের মধ্যে বিভেদের বীজ ঢুকিয়েছিল।
দেশটা ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে তাই পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা আর ইন্ডিয়া থেকে মুসলমানেরা স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে, তবে সেটা মূলতঃ ঘটেছে পাঞ্জাব আর বাংলায় - দেশের সাথে সাথে যে প্রদেশগুলোও বিভক্ত হয়েছিল। তাই ধর্মভিত্তিক দেশান্তর ঘটলেও এই দুই প্রদেশ বিভক্ত না হলে দেশত্যাগ বা দেশ থেকে বিতাড়নের স্কেলটা অন্যরকম হতো বলেই আমার বিশ্বাস।
তাই আমার মনে হয় দেশভাগ যতটা না স্বতঃসফুর্ত তার চেয়ে বেশি করে চাপিয়ে দেয়া। আর চাপিয়ে দেয়া বলেই মানুষ বেশীদিন সেটা মেনে নেয়নি, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে সবার জন্য এনেছে স্বাধীনতা। কিনতু তার পরও আমরা আবার কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোলাজলে আটকে পড়লাম? ক্ষমতার লোভ আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে।
গত সোমবার এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ী ফেরার পথে শুনলাম বিধানকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। বিধান আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে, আমার থেকে একটু ছোট, তবে একই সাথে ডাংগুলি খেলে বড় হয়েছি আমরা, ছোট বেলা থেকেই যখন যা দরকার - করে দিতো, আমরাও বাড়ীর লোকের মতোই ভালোবাসতাম ওকে। শুনলাম বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর ছিল। গরিবের যেটা হয়, ভেবেছিলো সেরে যাবে, সারেনি। তাই এই সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া . পরের দিন মানিকগঞ্জ কমরেডদের সাথে দেখা করতে যাবার পথে ওর ওখানে গেলাম। দেখে মোটেই ভালো লাগছিলো না। চারিদিকে রুগী দিয়ে ভর্তি। অল্পবয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ দিয়ে ভর্তি জায়গাটা। অধিকাংশই গরীব। পোশাক আশাক আর অসুস্থতা - সব মিলে চিৎকার করে দারিদ্র্যকে জানান দিয়ে যাচ্ছে। তার পরেও একটা জিনিস আমার মনে আশা জাগালো - পোশাক দেখেই বুঝলাম - এখানে হিন্দু-মুসলিম শুয়ে-বসে আছে পাশাপাশি বেডে। অনেকদিন পরে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একটা ছবি দেখলাম, অসামপ্রদায়িক, কিনতু অসুস্থ বাংলাদেশের ছবি। উপযুক্ত ডাক্তার, ওষুধ আর চিকিৎসার অভাবে অনেক রুগীই জীবনের শেষ দিন গুনছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশও তেমনি অপেক্ষা করছে সুস্থ রাজনীতির, নির্ভীক ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের। আসবে কি সেই দিন?
তরা, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬
Subscribe to:
Posts (Atom)