Friday, January 27, 2017

৩১ হিজল তলা

যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন ক্রমশই বাড়ছিলো। এতদিন আমাদের এলাকায় বলতে গেলে যুদ্ধের নাম-গন্ধই ছিল না। শুধু মাঝে মধ্যে খবর পেতাম আজ এই এলাকায় আগুন লাগিয়েছে  বা কাল ওখান থেকে কিছু লোক ধরে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেটা মুলত ছিল এক তরফা। কিন্তু ইদানীং কালে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পদ্মা পারে সংঘর্ষের খবর আসতে লাগলো। এছাড়া রেডিও তো ছিলই। যার ফলে সবার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জাগছিল যে খুব তাড়াতাড়িই দেশ স্বাধীন হবে, আমরা আবার ফিরে যাবো নিজেদের বাড়ি। তবে এই আনন্দ মুহূর্তেই উবে যেত বিদায়ের কথা ভেবে।


আমরা বাড়ি ছেড়েছি চৈত্র মাসে। তার পর গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষার শুরুতে আমরা আসি বৈলতলা। তখনও বইরাগীর চকে জল আসেনি। এরপর থেকে কত জল চলে গেছে এই চক দিয়ে। চলে গেছে বর্ষা, শরতের আকাশে ভেসে গেছে শুভ্র তুলার মত মেঘের পর মেঘ। হেমন্তও যাই যাই করছে। প্রথম দিকে তরার জন্য, পাড়ার বন্ধুদের জন্য মন পুড়লেও এখন বৈলতলাই হয়েছে নতুন আবাস, ছানা-হারুরা নতুন বন্ধু। তাই যখনই ভাবতাম, খুব শীঘ্রই এই গ্রাম ছেঁড়ে, এই নতুন বন্ধুদের ছেঁড়ে চলে যেতে হবে, মনটা কেন যেন ভরে যেত বিষণ্ণতায়। তাই তখন খেলার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই দৌড়ে চলে যেতাম ওই দেবদারু গাছটার নীচে। কখনো বা হিজল তলায়।            


 বাড়ির সামনের খালটা তখন শুকিয়ে গেছে প্রায়, শুধু কুমগুলো তখনও জলে টইটম্বুর। কখনও শিং মাছ, কখনও কই আবার কখনও বা শোল মাছ লাফিয়ে উঠে জানান দিচ্ছে ওখানে জীবনের উপস্থিতি। আর আছে সেই চুলপ্যাচানী, যে কিনা তার লম্বা চুল দিয়ে মানুষ টেনে নিয়ে যায় জলের নীচে নিজের আস্তানায়। তারপরেও এখন ভালো লাগত কুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছেদের লম্ফঝম্প দেখতে।


বইরাগীর চকে শুরু হয়েছে রবি শস্যের চাষ। এখানে সেখানে সরষেগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, হাল্কা বাতাসে মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোন চাষিকে। হাঁটতে হাঁটতে বইরাগীর চক ধরে চলে যেতাম দূরে বহু দূরে। পেছনে তাকিয়ে দেখতাম মাখন কাকার বাড়িটা ছোট হয়ে আসছে। এক অজানা ভয়ে ভরে উঠত বুকটা। নদীর তীর থেকে সাতার কাটতে কাটতে অনেক দূর গিয়ে পেছন দিকে তাকালে যেমন ভয় হয়, দ্রুত তীরে ফেরার প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগে মনে, চকের মাঝে একা দাঁড়িয়ে অনেক দূরে মাখন কাকার বাড়িটা দেখে আমারও ঠিক তেমনটাই মনে হতো। নাকমুখ বন্ধ করে দৌড়ুতাম যতক্ষন না পৌঁছে যেতাম বাড়ির ভেতর, একেবারে মায়ের কোলে।


এসবের মধ্যেই নিজেকে বলতাম, বাড়ি যাবো তাতে কি, সময় করে আবার আসব বেড়াতে এই বৈলতলায়, এই হিজলের কাছে দেবদারুর নীচে, আবার হেঁটে বেড়াবো এই বইরাগীর চকে। কিন্তু সেই দিনগুলি আর ফিরে আসেনি। এর পর কতবার যে এ ভাবে একের পর এক প্রিয় জায়গাগুলো ছেড়েছি, আর কতবার যে ভেবেছি ফিরে আসবো – কিন্তু সময় শুধু এগিয়েই গেছে, পিছু ফিরে আসেনি কখনও।


মনে পড়ে, যখন প্রাইমারী স্কুল শেষ করি, বড় মাষ্টারমশাইকে বার বার বলেছি, সময় পেলেই চলে আসব স্কুলে, আপনাদের সাথে দেখা করতে। ওই স্কুল সরে গেছে অন্য জায়গায়, কিন্তু আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হাই স্কুল যখন শেষ করি, একই ভাবে বন্ধুদের বলেছি, ভাবিস না, বিকেল হলেই চলে আসবো স্কুলের মাঠে, আড্ডা দেবো তোদের সাথে। সে আড্ডাটা বন্ধুদের এখন পাওনা রয়ে গেছে। কলেজেও ফিরে যাওয়া হয়নি প্রিয় স্যারদের কাছে। ১৯৮৩ সালে যখন দেশ ছেঁড়ে চলে আসি মস্কোয় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য, কথা ছিল পড়াশুনা শেষ হলেই চলে যাবো দেশে, শিক্ষকতা করব, খেলাঘর করব, পার্টি করবো। জীবনে নানান চড়াই উৎরাই দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পথ হারিয়ে ফেলেছি? দেশেও ফেরা হয়নি আর।  


অনেক আগে কোন এক কথা প্রসঙ্গে অমলদা নিজে অথবা অমলদার উদ্ধৃতি দিয়ে কে যেন বলেছিল, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা পড়ার জন্য কিছু কাগজ আর কলম হলেই যথেষ্ট। যদিও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার প্রতি আমার আকর্ষণ বরাবরের, ওই কথা শোনার পর আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এখন তো মনে হয়, আমার শুধু কাগজ কলম, কিছু বই, আর চা থাকলে এই পৃথিবীর যেকোনো জায়গাকেই আমি আপন করে নিতে পারি। আর এ কারনেই হয়ত কখনই আর পেছন ফিরে তাকানো হয়না, ফিরে যাওয়া হয়না প্রিয় সেই জায়গাগুলোয়।

দুবনা, ২৭ জানুয়ারী ২০১৭ 





              

Sunday, January 15, 2017

৩০ ভারতীয় সেনা

পাকিস্তানের ভারত আক্রমন বা ভারতের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়িতে এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। আমাদের ছোটদের মধ্যে অবশ্য দ্বিধার অবকাশ ছিল না। আগে আমাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় শুধু দুটো পক্ষ ছিল, মুক্তিবাহিনী আর পাক বাহিনী। রাজাকারদের আমরা ঐ হানাদারদের দলেই ঢুকিয়ে দিতাম। যুদ্ধ হতো রক্তক্ষয়ী আর আপোষহীন। কখনো কখনো মুক্তিবাহিনী কোণঠাসা হলেও শেষ পর্যন্ত ওরাই জিততো এই যুদ্ধে। এখন ভারতীয় সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে নামার ফলে আমাদের খেলাতেও যৌথবাহিনীর আবির্ভাব হোল, আর এখন থেকে এই বাহিনী অনায়াসে পাকসেনা আর তাদের দেশীয় দোসরদের হারিয়ে দিতে লাগলো। শুধু তাই নয়, ঐ সময়ে আকা আমার ছবিগুলোতে ট্যাঙ্ক আর ফাইটার বিমানের আনাগোনা শুরু হোল। আমরা ছোটরা খুব পজিটিভলি নিলাম ভারতীয় সেনার আগমন। বাড়ির মহিলামহলেও খুব আগ্রহের সাথে গৃহীত হোল এই ব্যাপারটা। তবে ঐ সময় বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাই আর মাখন কাকার কথায় মনে হোল ওনারা এই ব্যাপারটাতে খুশি হলেও একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ।
ঐ সময়ে এতসব বোঝার ক্ষমতা ছিল না, তবে পরবর্তী কালে বিভিন্ন ঘটনায় ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে। সত্যি বলতে কি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্যে হলেও বাংলার হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য এটা ছিল দুটো ভিন্ন যুদ্ধ। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে যখন পাকিস্তানের দাবীটা খুব জোরেশোরে উঠলো আর এই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়তে লাগলো সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলার কুলে, তখন থেকেই পূর্ববাংলার হিন্দুরা হারাতে লাগলো সাত পুরুষের ভিটে আর পায়ের নীচের মাটি। আর এরপর থেকেই বাঙ্গালী মুসলমানের যে কোন আন্দলনে, তা হোক সে পাকিস্তানের আন্দোলন, সায়ত্ব শাসনের আন্দোলন বা স্বাধীনতার লড়াই – সব সময়ই এ অঞ্চলের হিন্দুরা ছিল রিসিভিং  এন্ডে। ফিজিক্সে এনট্রপি বলে একটা কথা আছে, যেটাকে বলা যায় বিশৃঙ্খলতার মাত্রা, যেটা সব সময়ই বৃদ্ধি পায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে হিন্দুদের পূর্ব বাংলা বা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ত্যাগ আর দেশে থাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা অনেকটা এনট্রপির মতই, সময়ের সাথে যা শুধু বেড়েই যাচ্ছে। মনে হয় জীবনের অভিজ্ঞতাই বাবাদের শিখিয়েছিল সংশয়বাদী হতে, তাই ভারতীয় সৈন্যের যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণে মনে মনে খুশি হলেও একটা দুশ্চিন্তাও তাদেরকে ঘিরে রেখেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। অবিভক্ত ভারতে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ চললে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এই বাস্তবতাকে  মেনে নেয়া উচ্চবর্গের মুসলিমদের জন্যও ছিল খুবি কঠিন, কেননা ব্রিটিশরা এই মুসলিম রাজন্যবর্গের হাত থেকেই ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। চল্লিশের দশক থেকে জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন নতুন গতি পায়, আর নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার একটাই উদ্দেশ্য ছিল – ব্রিটিশ রাজের কাছে প্রমান করা, যে অবিভক্ত ভারতে হিন্দু আর মুসলমান এক সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে অক্ষম। শুধু সেটাই না, জিন্নাহ বলতেন (হয়ত-বা বিশ্বাসও করতেন) যদি ভারত আর পাকিস্তান নামের দুটো আলাদা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দু-মুসলমান বিরোধিতা আর থাকবে না, ভারত আর পাকিস্তান হবে বন্ধুত্বপূর্ণ দুটো রাষ্ট্র যারা সব সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়াবে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ ঘোষণা করেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, সবাই হবে পাকিস্তানের নাগরিক, সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে এই নতুন দেশে। কিন্তু সত্যটা ছিল ঠিক বিপরীত। ভারত আর পাকিস্তান কোন দিনই বন্ধু রাষ্ট্রে পরিনত হয়নি। এতদিন মানে পার্টিশনের আগ পর্যন্ত দ্বন্দ্বটা ছিল দুই সম্প্রদায়ের। তার উপরে ছিল রাষ্ট্র। চাক আর নাই চাক, রাষ্ট্রকে এই দুই সম্প্রদায়ের লড়াইতে হস্তক্ষেপ করতে হতো, পালন করতে হতো নিরপেক্ষ ভুমিকা। পার্টিশনের ফলে ভারত ভেঙ্গে দুটো দেশ হোল। মানুষগুলো রয়ে গেলো আগের মতই তাদের সব বিশ্বাস আর ঘৃণা বুকে নিয়ে। এই ঘৃণা তো কমলোই না, বরং এতে যোগ হোল নতুন উপাদান। হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরকে ঘৃণা করার সাথে সাথে ঘৃণা করতে শুরু করল যথাক্রমে পাকিস্তান আর ভারতকে। সম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিনত হোল দুই রাষ্ট্রের লড়াইয়ে।
বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে ভারতের হিন্দু যেমন মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে সাথে পাকিস্তানকে শত্রু ভাবতে শিখে, ঠিক তেমন করেই পাকিস্তানের মুসলমান হিন্দুদের পাশাপাশি ভারতকেও শত্রু ভাবার তালিম পায়। এখনও মনে পড়ে ১৯৬৯ সালে কলকাতা যাবার কথা। ঐ প্রথম দেখি কোন পাঞ্জাবী অফিসারকে। আমি আর আমার বড় ভাই রতন যাচ্ছিলাম মার সাথে পশ্চিম বঙ্গে মামাবাড়ি। ছোট কাকা গেছিল আমাদের বেনাপোল বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। ঐ অফিসার মাকে সমস্ত গয়না, মানে কানের দুল, মালা, আংটি এসব কাকার মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করে। এর পর চেকিং তো ছিলই। চেকিং ছিল বর্ডারের ওপারেও। শুধুমাত্র পরস্পরের মধ্যে তীব্র ঘৃণা আর সন্দেহই এমন পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। তাই ভারতীয় সৈন্য যখন সরাসরি যুদ্ধে নামলো, বাবাদের মনে প্রশ্ন জাগলো এতদিন এলাকার যে সব মুসলমান আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা এই নতুন বাস্তবতায় কি করবেন? তারা কি এখন ভারতীয় বাহিনীকে হানাদার বাহিনী বলে গন্য করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আর এই বিরধীতার প্রথম শিকার কি আমরা হব? তবে সব কিছুর পরেও ঐ সময় দুই বাংলার জনগন অভূতপূর্ব ঐক্য দেখায়। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান নাট্যকর্মী নাসিরুদ্দিন ইউসুফ মস্কোতে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “একাত্তরে দুই বাংলার মানুষ যতটা আত্মীয়তা, যতটা একাত্মতা দেখিয়েছে, সেটা একাত্তরের পূর্বে বা পরে কোন দিনই                                       এই ভূখণ্ডে দেখা যায়নি।“
আজ যখন সাতচল্লিশের সেই দিনগুলির ইতিহাস পড়ি বা সিনেমা দেখি, ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে দুই বাংলার মানুষ কাঁধে কাঁধ রেখে একাত্তরে লড়াই করতে পেড়েছে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের মানুষগুলো। মাত্র দু যুগ আগে এরাই নিজেদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি ত্যাগ করে দেশান্তরী হয়েছিল, আর মানব সন্তানদের এই ঐতিহাসিক স্থানান্তরে পারস্পারিক   হামলায়, অনাহারে আর রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল লাখ লাখ মানুষ। আর ঐ দিন যাদের কারনে তারা হয়েছিল দেশহারা, আজ তারাই দলে দলে আশ্রয় চাচ্ছে তাদের কাছে। আজ সেই মানুষগুলো তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, প্রতিশোধ নিতে চায়নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত, আশ্রয় দিয়েছে নিজের ঘরে। আর যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বতভাবে সাহায্য করেছে আমাদের বিজয়কে এগিয়ে আনার জন্য। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বা ভারত সরকারের কাছে এটা রাজনীতির প্রশ্ন হলেও সাধারন মানুষ তার ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য ছিল না। তারা এটা করেছে প্রানের টানে, মাটির ডাকে। আজও পশ্চিম বঙ্গে বেড়াতে গেলে কেউ যখন শোনে আমি বাংলাদেশ থেকে, প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে দেশের কথা, বলে নিজেদের রেখে আসা বাড়িঘর আর প্রতিবেশীদের কথা। “কেমন যে এ ভালোবাসা, কেমন যে এ মাটির টান – যারা এ মাটি হারিয়েছে, শুধু তারাই বোঝে।“        


মস্কো, ১৫ জানুয়ারী ২০১৭


Tuesday, January 3, 2017

২৯ ধুমকেতু

খুব সকালে বাইরের হৈচৈ সেদিন ঘুম ভেঙ্গে গেল আমি অবশ্য দেশে বরাবরই সকালে উঠি, অন্তত চোখ  খুলিযদিও এখন রাশিয়ায় ঘুম থেকে উঠতে উঠতে একু দেরী হয়ে যায় ছোট বেলায়, মানে স্কুলে যখন পরতাম, তখন তো ভোর চারটের সময় উঠে ফুটবল খেলতে যেতাম পাড়ার ছেলেদের সাথে যাতে সাতটায় বাড়ী ফিরে পড়তে বসতে পারি আর সময় মত স্কুলে যেতে পারি বাবা সব সময় খুব সকালে উঠত, উঠেই প্রাত ভ্রমনে বেরুত, অনেকসময় মালাটা ওই সময়েই জপে নিত এর  পর পড়ত গীতা বা চন্ডী তাই কখনো কখনো বাবার ওঠার শব্দেই ঘুম ভাঙ্গত | তবে ওসব দিনে সকালে মূলত ঘুম ভাঙ্গত আজানের শব্দে বা প্রভাত কীর্তনে গ্রামের একমাত্র মসজিদ থেকে ভেসে আসত আজানের সুর

আল্লাহ আকবর ...............

তখনও মাইক ব্যবহার হত না, তবে ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আজানের সেই মিষ্টি সুর আমাদের কানে এসে পৌছুত, অনেকটা এলার্মের মত কাজ করত

কোন কোন দিন তারও আগে চলে আসত বৈরাগীরা - স্থানীয় বা দূর-দুরান্তের  কত গানই না গাইত  ওরা এখনো কানে আসে সেই

ভর সময় কালে কোকিলা ডাকে ডালে
ভ্রমরা হরি গুন গায়রে ...................

অথবা

প্রভাতে গোবিন্দ নাম
সিদ্ধ হবে মনষ্কাম 
আনতে হবে বৈকুন্ঠ নিবাসী
জাগিয়া লহ কৃষ্ণ নাম
হে নগর বাসী .....

স্থানীয় ছিল ফটিক সাধু, পাশের বাড়ীর লোক, রাজবংশী - যদিও দিন কাটাত গান গেয়ে আর রমন বৈরাগীর সেবায় সকালে একতারা বাজিয়ে বাড়ী বাড়ী গান গাইত আর দুপুরে মাঝে মধ্যে আসত সিধা নিতে ভিক্ষুকরা ভিক্ষা নিত, আর বৈরাগীরা নিত সিধা নামগত পার্থক্য থাকলেও দুটোর গুনগত পার্থক্য  আমি জানি নাকেউ জানে কিনা তাও জানি না | তাছাড়া সিধা শব্দটা আঞ্চলিক হলেও অবাক হব না     
এছাড়া একটু দুরের গ্রাম থেকে আসত বৈরাগী বৈরাগিনী ওদের হাতে থাকত সারেঙ্গী - বেহালার মত এক বাদ্য যন্ত্র তবে যে সাধুটা আমাদের বাচ্চাদের মনে সবচেয়ে বেশী কৌতুহলের উদ্রেক করত সে আসত বর্ষা কালে, নৌকা করে আমাদের ঘাটে দিনের পর দিন ভেড়ানো থাকত তার নৌকা বৃষ্টি নেই বাদল নেই - বর্ষার কয় মাস তার নৌকা থাকত আমাদের ঘটে, আর ভো হলেই তার দোতারার সুর আর প্রভাত কীর্তনে মুখরিত হত গ্রাম ওই ছোট্ট এক মালিয়া নৌকাতেই সে রান্না করত আর ওই নৌকা থেকে বেরুত চন্দনের বা ওই জাতীয় কিছু একটা ঘ্রাণ আমরা বাচ্চারা সাতার কাটতাম ওই নৌকার আশে পাশে আর বোঝার চেষ্টা করতামকিভাবে দিনের পর দিন নৌকায় কাটায় গেরুয়া পরা আর লম্বা  সাদা  চুল দাড়িওয়ালা এই মানুষটা সব সময় আমরা যে ভদ্রস্থ  ভাবে সেটা করতাম তা নয়, তাই কখনো সখনো সাধু রেগে গিয়ে আমাদের তাড়া করত তবে কোনো দিনই সেটা সীমা অতিক্রম করে নি কোনো দিক থেকেই মনে পরে একবার ভরা বর্ষাতেও যখন ওই সাধুর দেখা মিললো না, আমাদের কত জল্পনা-কল্পনা কেউ বলল সাধু অসুস্থ, কেউ বলল মরে গেছে তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেবারও সাধু ঠিকই এসেছিল এরপর আমরা নিজেরাই বড় হয়ে গেছিলাম, ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম নিজেদের জীবন নিয়ে কোন সাধু গেল আর  কোন সাধু এলো সেটার হিসেব রাখার সময় আর ছিলনা
এখন আমাদের গ্রামে অবশ্য একটা দুটো নয়, অনেকগুলো মসজিদ প্রতিদিন সকালে চারিদিক থেকে আসে আজানের শব্দ আর তাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় চারিদিক থেকে আসার কারণেই কিনা কে জানে, এই আজানের ধ্বনি আগের মত ঠিক সব সময় মধুর মনে হয় নাকখনো কখনো  আগ্রাসী মনে হয় তখন আমার মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ওয়ারশ জোট পতনের পর ন্যাটোর ক্রমশ রুশ সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাবার কথা  সমাজতান্ত্রিক জোট পতনের পর যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাশিয়াকে সাথে নিয়ে ইউরোপে শান্তি বিরাজের কথা ছিল, ন্যাটোর সম্প্রসারণে তা বরং আগ্রাসী আকার ধারণ করেছে, বেড়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অশান্তি নেমে এসেছে সারা ইউরোপ জুড়ে যদিও মসজিদের সাথে সাথে গ্রামে এখন মন্দিরের সংখ্যাও বেড়েছে, আগের সেই প্রশান্ত পরিবেশ আর নেই আচ্ছা এই যে এত উন্নতি, এত রাস্তা ঘাট, ডিজিটাল জীবন - তার পরেও  কেন হারিয়ে যায়  শৈশবের সেই সুমধুর আজানের ধ্বনি বা বৈরাগীর গান?

এবার দেশে গিয়ে একটা ব্যপার লক্ষ্য করলাম। ২০১৪ তেও বাসে কন্ডাক্টর “ভাই ভাড়া দেন, মামু টাকাটা দেখি বা চাচা একটু চাপুন তো” বলে সম্বোধন করত। এবার শে জায়গা নিয়েছে দাদা আর কাকা। একদিন এক কন্ডাক্টর যখন দাড়িওয়ালা আর টুপি পরা এক ভদ্রলোককে “দাদা, ভারাটা দেখি” বলল, আমি অল্পের জন্য হেসে ফেলিনি। আবার কয়েক দিন আগে দেখি এক বন্ধু ছবি দিয়েছে, যেখানে তাদেরকে ধান্দুরবা দিয়ে বরন করে নিচ্ছে। গায়ে হলুদের কথা নাই বললাম। আজকাল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বিয়ের থেকেও বেশী আড়ম্বরপূর্ণ। এসব লিখছি এই জন্যে এক সময় এ সবই হিন্দু সংস্কৃতি বলে বর্জন করা হতো। আমার কিন্তু মনে হয় এসবই একান্ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি। আমেরিকার ইংলিশরা যেমন ব্রিটেনের ইংলিশদের থেকে আলাদা দেখান জন্য ভাষাটা একটু অন্যভাবে বলত, বাঙ্গালী মুসলমানও হিন্দুদের থেকে নিজেকে আলাদা করার জন্য অনেক বাঙ্গালী প্রথা বর্জন করেছিল। এখন পহেলা বৈশাখ, গায়ে হলুদ এসব বাঙ্গালীর এই প্রধান দুই গোষ্ঠীর মানুষকে সাংস্কৃতিক ভাবে কাছে নিয়ে আসছে। আগের মতই এখনও ঈদে বা পুজায় এক সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের নিমন্ত্রন করে। যদি আগে দু সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য আলাদা বসার ব্যাবস্থা ছিল, এখন তারা পাশাপাশি বসে খায়। এত সব কিছুর পরেও যখন দেখি আজ এই দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বাড়ছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, বাড়ছে অসহিস্নুতা – মনে হয় প্যারাডক্স এটাই আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য।          

যাকগে ফিরে আসা যাক সেই সকালে যদিও যুদ্ধের সময় বাড়ীতে সবাই খুব সতর্র্ক থাকত আর যথা সম্ভব সকালে উঠত, এদিন সবাই যেন একটু আগেই উঠে বসেছিল ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি বড়রা সবাই দাড়িয়ে  আছে  আর পূব আকাশে  জ্বল জ্বল করছে কি এক লেজুড়ে জিনিষ, যেন দেব দূতরা নেমে আসছে আকাশ থেকে একটার পর একটা  এক ধরনের আতংক বিস্ময় সবার চোখে মুখে শেষ পর্যন্ত কে যেন বলল, এগুলো প্যারাসুট। ভারতীয় সৈন্য নামছে মানিকগঞ্জের জাগিরে  প্যারাসুটে করে জীবনে ওই প্রথম প্যারাসুট দেখা অনেক দিন পরে সত্তর দশকের শেষের দিকে যখন গ্রামের সমিতির ঘর থেকে যাত্রা দেখে ভোর রাতে বাড়ী ফিরতাম, একটা বিশাল লেজ যুক্ত ধুমকেতু দাড়িয়ে থাকত পূব আকাশে ওটাকে দেখে আমার মনে হত ওই প্যারাস্যুট গুলোর কথা হয়তো বা ভোরের আকাশে সূর্যের আলো   পড়ায়  প্যারাসুট গুলো ধুমকেতুর মত লাগছিল, হয়ত বা একেবারেই ধুমকেতুর মত ছিল না, কিন্তু আমার শিশু মনে ঐযে চিত্রটা গেথে গেছিল সারা জীবনের জন্য, তা এখনো যেন ভাসছে  চোখের সামনে


তরা, মস্কো – ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ – ৩ জানুয়ারী ২০১৭