যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন ক্রমশই বাড়ছিলো। এতদিন আমাদের এলাকায় বলতে গেলে
যুদ্ধের নাম-গন্ধই ছিল না। শুধু মাঝে মধ্যে খবর পেতাম আজ এই এলাকায় আগুন লাগিয়েছে বা কাল ওখান থেকে কিছু লোক ধরে নিয়ে গিয়েছে,
কিন্তু সেটা মুলত ছিল এক তরফা। কিন্তু ইদানীং কালে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায়,
বিশেষ করে পদ্মা পারে সংঘর্ষের খবর আসতে লাগলো। এছাড়া রেডিও তো ছিলই। যার ফলে সবার
মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জাগছিল যে খুব তাড়াতাড়িই দেশ স্বাধীন হবে, আমরা আবার
ফিরে যাবো নিজেদের বাড়ি। তবে এই আনন্দ মুহূর্তেই উবে যেত বিদায়ের কথা ভেবে।
আমরা বাড়ি ছেড়েছি চৈত্র মাসে। তার পর গ্রীষ্ম কাটিয়ে বর্ষার শুরুতে আমরা
আসি বৈলতলা। তখনও বইরাগীর চকে জল আসেনি। এরপর থেকে কত জল চলে গেছে এই চক দিয়ে। চলে
গেছে বর্ষা, শরতের আকাশে ভেসে গেছে শুভ্র তুলার মত মেঘের পর মেঘ। হেমন্তও যাই যাই
করছে। প্রথম দিকে তরার জন্য, পাড়ার বন্ধুদের জন্য মন পুড়লেও এখন বৈলতলাই হয়েছে
নতুন আবাস, ছানা-হারুরা নতুন বন্ধু। তাই যখনই ভাবতাম, খুব শীঘ্রই এই গ্রাম ছেঁড়ে,
এই নতুন বন্ধুদের ছেঁড়ে চলে যেতে হবে, মনটা কেন যেন ভরে যেত বিষণ্ণতায়। তাই তখন
খেলার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই দৌড়ে চলে যেতাম ওই দেবদারু গাছটার নীচে। কখনো বা হিজল
তলায়।
বাড়ির সামনের খালটা তখন শুকিয়ে গেছে প্রায়, শুধু
কুমগুলো তখনও জলে টইটম্বুর। কখনও শিং মাছ, কখনও কই আবার কখনও বা শোল মাছ লাফিয়ে
উঠে জানান দিচ্ছে ওখানে জীবনের উপস্থিতি। আর আছে সেই চুলপ্যাচানী, যে কিনা তার
লম্বা চুল দিয়ে মানুষ টেনে নিয়ে যায় জলের নীচে নিজের আস্তানায়। তারপরেও এখন ভালো
লাগত কুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছেদের লম্ফঝম্প দেখতে।
বইরাগীর চকে শুরু হয়েছে রবি শস্যের চাষ। এখানে সেখানে সরষেগুলো মাথা চাড়া
দিয়ে উঠেছে, হাল্কা বাতাসে মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোন
চাষিকে। হাঁটতে হাঁটতে বইরাগীর চক ধরে চলে যেতাম দূরে বহু দূরে। পেছনে তাকিয়ে
দেখতাম মাখন কাকার বাড়িটা ছোট হয়ে আসছে। এক অজানা ভয়ে ভরে উঠত বুকটা। নদীর তীর
থেকে সাতার কাটতে কাটতে অনেক দূর গিয়ে পেছন দিকে তাকালে যেমন ভয় হয়, দ্রুত তীরে
ফেরার প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগে মনে, চকের মাঝে একা দাঁড়িয়ে অনেক দূরে মাখন কাকার বাড়িটা
দেখে আমারও ঠিক তেমনটাই মনে হতো। নাকমুখ বন্ধ করে দৌড়ুতাম যতক্ষন না পৌঁছে যেতাম
বাড়ির ভেতর, একেবারে মায়ের কোলে।
এসবের মধ্যেই নিজেকে বলতাম, বাড়ি যাবো তাতে কি, সময় করে আবার আসব বেড়াতে এই
বৈলতলায়, এই হিজলের কাছে দেবদারুর নীচে, আবার হেঁটে বেড়াবো এই বইরাগীর চকে। কিন্তু
সেই দিনগুলি আর ফিরে আসেনি। এর পর কতবার যে এ ভাবে একের পর এক প্রিয় জায়গাগুলো
ছেড়েছি, আর কতবার যে ভেবেছি ফিরে আসবো – কিন্তু সময় শুধু এগিয়েই গেছে, পিছু ফিরে
আসেনি কখনও।
মনে পড়ে, যখন প্রাইমারী স্কুল শেষ করি, বড় মাষ্টারমশাইকে বার বার বলেছি,
সময় পেলেই চলে আসব স্কুলে, আপনাদের সাথে দেখা করতে। ওই স্কুল সরে গেছে অন্য
জায়গায়, কিন্তু আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হাই স্কুল যখন শেষ করি, একই ভাবে
বন্ধুদের বলেছি, ভাবিস না, বিকেল হলেই চলে আসবো স্কুলের মাঠে, আড্ডা দেবো তোদের
সাথে। সে আড্ডাটা বন্ধুদের এখন পাওনা রয়ে গেছে। কলেজেও ফিরে যাওয়া হয়নি প্রিয়
স্যারদের কাছে। ১৯৮৩ সালে যখন দেশ ছেঁড়ে চলে আসি মস্কোয় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য,
কথা ছিল পড়াশুনা শেষ হলেই চলে যাবো দেশে, শিক্ষকতা করব, খেলাঘর করব, পার্টি করবো।
জীবনে নানান চড়াই উৎরাই দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পথ হারিয়ে ফেলেছি? দেশেও ফেরা
হয়নি আর।
অনেক আগে কোন এক কথা প্রসঙ্গে অমলদা নিজে অথবা অমলদার উদ্ধৃতি দিয়ে কে যেন বলেছিল, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা পড়ার জন্য কিছু কাগজ আর কলম হলেই যথেষ্ট। যদিও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার প্রতি আমার আকর্ষণ বরাবরের, ওই কথা শোনার পর আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এখন তো মনে হয়, আমার শুধু কাগজ কলম, কিছু বই, আর চা থাকলে এই পৃথিবীর যেকোনো জায়গাকেই আমি আপন করে নিতে পারি। আর এ কারনেই হয়ত কখনই আর পেছন ফিরে তাকানো হয়না, ফিরে যাওয়া হয়না প্রিয় সেই জায়গাগুলোয়।
দুবনা, ২৭ জানুয়ারী ২০১৭