আমি বাড়ীর ১৭ ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট। যদিও ১৯৭০ এ কলকাতায় সুবোধদার ছেলে বাপীর জন্ম হয়, ১৯৭৫ এ ভ্রমরের জন্মের আগে পর্যন্ত বাড়িতে ছিলাম আমিই সবার ছোট, সবার আদরের। ছোট হওয়ায় এক আধটু বকা-ঝকা শুনলেও আদরটাই মেলে খুব বেশী করে, অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়। তাই এখনো সেভার প্রতি আমার একটু পক্ষপাতিত্ব থেকেই যায়, মনিকা, ক্রিস্টিনা সেভার প্রতি আরেকটু বেশী উদার হোক, এটাই চাই, ফলে মাঝে মধ্যে আমাকেও ওদের বকা খেতে হয়। তবে ছোট হওয়ার আরেকটি সুবিধা হলো, যখন অতীতের কোনো ঘটনা কল্পনা আর বাস্তবতার একটা পাঁচমিশালী মনে হয়, বড়দের কাছ থেকে তার সত্যতা বা অসত্যতা জেনে নেয়া যায়। তবে লেখাটা যেহেতু আমিই লিখছি আমার স্মৃতি থেকে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই ওরা একটা লেখা পড়ার পর মন্তব্য করতে পারে, ঘটনা সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য আমাকে দিতে পারে। তাই মনে হয় আমার এ স্মৃতিচারণ নিউটনের সূত্র মেনে সমগতিতে সরল পথে এগুবে না, বরং রথের মেলার ভীড়ের ধাক্কায় কখনো সামনে এগুবে, কখনো বা পিছু হটবে। তবে বাস্তব জীবনে সব এভাবেই ঘটে, তাই আশা করি পাঠক একটু ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে সামনে এগুবেন।
আমার মনে হয়েছিল মার্চের শেষের দিকেই আমরা বাড়ী ছেড়ে চলে গেছিলাম, কেননা তরার শেষ দিনগুলো আমার তেমন মনে পড়ছিলো না। যতদূর মনে আছে সবাই ভীড় করে আকাশবাণী আর বিবিসি শুনতো আর আলোচনা করতো কি ঘটতে যাচ্ছে দেশে। কাল কল্যাণদা বললো, ৭ ই এপ্রিল মানিকগঞ্জের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে শুরু করলে সবাই আসন্ন আর্মি আসার আভাষ পায়, তাই ৮ই এপ্রিল আমরা বাড়ী ত্যাগ করি। আমাদের যাবার যে খুব বেশি জায়গা ছিল তা নয়। আমার মনে আছে, দেশে আমরা হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় মাত্র বেড়াতে যেতাম। ঝিটকা ছিল আমাদের পিসি বাড়ী, যাতায়াতের অসুবিধার কারণে আমরা যেতাম বর্ষা কালে, নৌকা করে। রাস্তায় কিছুক্ষেনের জন্য মন্টুদাদের বাড়িতে নেমে দুপুরে খেতাম। ঝিটকায় অনেকেই ছিল আমার সমবয়সী, সময় তাই ভালোই কাটতো। ওখানে সিন্ধি নারকেল ছিল খুব প্রিয়, নারকেল গুলো ছিল একটু হলদেটে, আর প্রিয় ছিল ওখানকার হাজারী খেজুরের গুড়। বাবা শনিবার করে ঝিটকা হাটে আসতো, তাই পিসিবাড়ী গেলে বাবার ওখানে যেতাম শনিবার। এছাড়াও যেতাম ঝিটকা জমিদার বাড়ী , আমাদের মামা বাড়ী, তত দিনে অবশ্য ওটা বেদখল হয়ে গেছিলো। এছাড়া কালে ভদ্রে যেতাম বাগজান মাসী বাড়ী, এটা ঢাকা-আরিচা রোডের পাশেই। মির্জাপুর যেতাম কখনো সখনো, ওখানে আমাদের বড় মামা থাকতো, মার্ জ্যাঠাতো ভাই। তখন যেতে হতো ঢাকা হয়ে। প্রথমে তরার ঘাট পার হয়ে ইপিআরটিসির বাসে নয়ারহাট, সেখানে আবার নদী পার হয়ে আমিন বাজার পর্যন্ত বাসে, আবার ফেরী , তারপর বাসে গুলিস্থান। সেখান থেকে কমলাপুরের ওদিক দিয়ে জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর ঘুরে তবে মির্জাপুর। সেখানেও ছিল একগাদা ভাইবোন। মার্ সাথে গেলে মা সব সময় রণদা প্রসাদ সাহার সাথে দেখা করতো, আমাদের কেমন যেন লতায় পাতায় আত্মীয় ছিলেন, উনি যখন সেই বিখ্যাত কুঁড়ে ঘরে এসে বসতেন, মা যেত দেখা করতে আমাকে নিয়ে। একবার আমরা গেলাম তাদের কোন এক বাসায়, ঠিক মনে নেই, টাঙ্গাইল না হোমসে, যেখানে শোকেসে ছিল বেশ কয়েকটা বড় বড় জাহাজ, আমি খুব ঘুরে ফিরে দেখতে শুরু করলে কে যেন বললো, "নিবে?" মা বললো, "দিদি দরকার নেই, এটা টানা কষ্ট এখন থেকে, ওর বাবা কিনে দেবে।" মনে হয়, ওটা যেখানে সেখানে পাওয়া যেত না, তাই বাবা আর কিনে দেয় নি। এছাড়া আমরা যেতাম ফরিদপুর জগদবন্ধু আশ্রমে, কি একটা মেলায়। ওখানে আমার প্রিয় ছিল পাঁপড় ভাজা আর মাটির বিরাট চিংড়ি মাছ। ফেরীতে করে পদ্মা পার হতাম, মাঝে মা দেখাতো কোথায় পদ্মা আর যমুনা মিশেছে। ওই সময় মহানামব্রত বহ্মচারী বছরে একবার আমাদের বাড়ী আসতেন ভাগবৎ পাঠ করতে। অনেক লোক হতো। উনি খুব ভালো বলতেন। এখন যখন বিভিন্ন ধর্মীয় জমায়েতে অন্য ধর্মের মুণ্ডুপাত করাটাই আসল, উনি শুধু ভববানের মাহাত্ম্যই বলতেন কোনো ধর্মের সমালোচনা না করে। এই একটা অনুষ্ঠান, যেখানে বাবা উপস্থিত থাকতো। যুদ্ধের শেষ দিকে ফরিদপুরের মঠ বোমা ফেলে ভেঙে দিলে যত দূর জানি উনি শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেছিলেন মঠটাকে পুনর্নির্মাণ করতে, সেটা বঙ্গবন্ধু করতে রাজী হননি, ফলে মহানামব্রত ব্রহ্মচারীও আর দেশে ফিরেন নি। আমি ১৯৭২ সালে তাকে শেষ দেখেছি কলকাতায়, খুব সম্ভব মানিকতলায়। এর পর বাড়িতে আর ভাগবৎ পাঠ হয়নি। যদিও রামমঙ্গল, পদাবলী, জারীগান এসব আমাদের বাড়ীতে আরো অনেক দিন পর্যন্ত হয়েছে।
তবে আমরা এসব কোনো জায়গায় না গিয়ে গেলাম মাইল্যাগী, সুধা পিসিদের বাড়ী। ওটা ছিলো ঘিওরের পাশেই, রাস্তার উপর। তখন আজকালকার মত রাস্তাঘাট ছিল না, ওখান দিয়ে মানুষ হাটতো, কখনো যেত ঘোড়ার গাড়ী। যেহেতু আমরা ছিলাম বিশাল পরিবার, তাই সবাই একসঙ্গে থাকা ছিল দুরূহ কাজ। ফলে একদল চলে গেলো ঘিওর বড়দির বাসায়। আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় বড়দি বা কালীদি। ওনার ছেলে দিলীপ মামা আমার থেকে বছর দশেকের বড়, ভালো গান গাইতো। মেয়ের বিয়েও আগেই হয়ে গেছিলো। আমরা বড়দির ওখানে বেড়াতে যেতাম, তবে আমার ভালো লাগতো না। ওনার ছিল শুচি বাই, অনবরত হাত -পা ধুত, ফলে হাতে-পায়ে ঘাঁ শুকাতো না কখনো। জামাইবাবুকে দেখিনি। শুনেছি, কলার খোসায় পা পিছলে পরে মারা যান। এমনিতে ডাক্তারী করতেন। উনি ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ভাস্তে। কল্যাণ দাও কাকাদের সাথে ওখানেই চলে গেছিলো, তবে ছিল মাত্র দু-তিন দিন, কেননা প্রায়ই রব উঠছিলো আর্মি আসলো বলে। পরে ওরা তেরশ্রী হয়ে চলে যায় দৌলতপুর দাদু বাড়ী।
মাইল্যাগি আমরা ছিলাম এপ্রিলের শেষ বা মে র প্রথম পর্যন্ত। আমার তেমন মনে পরে না সেই দিন গুলো। মনে আছে, একটু সুযোগ পেলেই রাস্তায় গিয়ে মার্বেল খেলতাম। তবে যেহেতু বাড়ী ছিল রাস্তার উপর, আর ভয় ছিল অন্যদের নজরে আসার, তাই বেশির ভাগ সময় বাড়ীর ভেতরেই লুকিয়ে থাকতাম। এটাকেই বলে পালিয়ে গিয়ে পালিয়ে থাকা। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, যতদিন আমরা মাইল্যাগী ছিলাম, সবার ধারণা ছিল আর মাত্র কয়েকটা দিন, গন্ডগোল থেমে যাবে, আমরা আবার বাড়ী ফিরে যাবো। বাড়ীতে তখন যুদ্ধ শব্দটা আসেনি, এটা ছিল সাময়িক গন্ডগোল, যেটা চল্লিশের দশক থেকে বার বার ঘটেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপে। তবে যখন গ্রামের হিন্দু বাড়ীঘর লুটের খবর এলো, আর খবর এলো পরেশ কাকা সহ বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর খবর সবার মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।
এতদিন যে মৃত্যুর খবরগুলো আসতো, তা ছিল শুধুই মৃত্যু, অবয়বহীন। শুনতাম হাজারে হাজারে মানুষ মরছে, সেই মানুষ গুলোকে কল্পনা করতে পারলেও তাদের কোনো নির্দিষ্ট চেহারা ছিল না। আমার এই ছোট্ট জীবনে বলতে গেলে কোনো মৃত্যু দেখিনি। ১৯৭০ এ আমার এক ঠাকুরমা মারা যায়। অনেক বুড়ো ছিল। আমায় জন্মের পর থেকেই তাকে দেখেছি ঘরে পড়া, নয়াবাড়ীর ঠাকুরমা। তাই বলতে গেলে আমার কাছে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একদিন দেখলাম বোম্বাই আম গাছের নিচে চিতা জ্বালিয়ে তাকে পোড়ানো হচ্ছে, শুধু কিছুদিন ভয় পেতাম ওই গাছের আম পারতে। আর এখন যারা মারা গেলো, তাঁরা সবাই পরিচিত। পরেশ কাকার বাড়ী আমাদের দু বাড়ী পরে। চালের দোকান করতো। তার ছেলে পরিমল আমার মার্বেল খেলার সাথী, মেয়ে কল্পনা-আল্পনা - ওদের সাথে ছি বুড়ি খেলতাম। মাত্র কদিন আগে ওদের আরেকটা ভাই হয়। তাই ওরা ছিল আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। নিরা কাকা, জগা কাকা দাদাদের সমবয়সী, প্রায়ই বেড়াতে আসতো। মা ডাকতো ওদের চা খেতে। টি স্টলে চা পাওয়া গেলেও গ্রামে খুব বেশি বাড়ীতে তখন চা হতো না, আমাদের চা হতো বেশ কয়েক বার, কেউ এলেই চা, মুড়ি এসব দিতো। রমেশদা আমাদের খদ্দের। বলাই গোসাই প্রায়ই আসতো। আসলে এসব মুখগুলোই ছিল খুব পরিচিত। তাই বলতে গেলে একাত্তরের মৃত মানুষগুলো এই প্রথম চেহারা পেল আমার বা আমাদের কল্পনায়। আমরা মৃত্যুর মুখ দেখলাম। এর সাথে সাথে ভেঙে গেলো দ্রুত বাড়ি ফেরার আশা। তাই যখন মাইল্যাগী এলাকার চেয়ারম্যান আমাদের এলাকা ছাড়তে বললো, আর কুদ্দুস ভাই বললো তাদের ওখানে যেতে, আমরা চললাম নতুন অনিশ্চয়তার পথে।
দুবনা, ১২ অক্টবর ২০১৬