Sunday, October 30, 2016

১০. স্বপ্নে দেখা বাড়ী

বৈলতলা আমরা উঠলাম মাখন কাকার বাড়ী।  মাখন চক্রবর্তী।  শশীজ্যাঠামশায়ের মত মাখন কাকাও আমাদের পূর্বপরিচিত ছিলেন না।  আমাদের পাইকার কালু ব্যাপারী আর হারান ব্যাপারী আমাদের নিয়ে আসে মাখন কাকার ওখানে।

মাখন কাকার বাড়ী  ছিল বেশ বড়, অনেকটা  আমাদের বাড়ীর  মতোই।  বাড়ীর  সামনে বেশ বড় একটা খাল, যদিও আমরা যখন এসে পৌঁছি ওটা শুকনা ছিল।  তবে কয়েক জায়গা  ছিল বেশ গভীর আর জলে ভর্তি।  ওগুলোকে বলতো কুম।  মাখন কাকা বলতো, ওই জায়গাগুলো অনেক গভীর, আর সেখানে বাস করে  চুল প্যাচানি। ওটা মনে হয় অক্টপাসের স্থানীয় নাম।  তবে আমার মনে হতো, চুল প্যাচানি নিশ্চয়ইঅনেকটা চাঁদের বুড়ির মতো,  যে নাকি চাঁদে  বসে চরকায়  সুতা কাটে আর চাঁদের আলো  ছড়িয়ে  দেয়  পৃথিবী জুড়ে।  চুল প্যাচানিও ঠিক তাই, শুধু তার লম্বা চুল দিয়ে পা জড়িয়ে ধরে মানুষের আর টানতে টানতে নিয়ে যায় গহীন জলের নীচে  তার আস্তানায়।  তাই আমি খুব ভয় পেতাম কুমের  জলে নামতে।

মাখন কাকা থাকতো বাড়ীর  ডান  দিকটায় একটা ঘরে।  তার ছিল তিন ছেলে আর দুই মেয়ে।  ছানা ছিল বড়, আমার থেকে বছর দুঁ তিনের  বড়  তো হবেই, আর হারু আমার সমবয়েসী। ছোট ছেলে ছিল প্রতিবন্ধী, নামটা মনে পড়ছে না।  বড় মেয়েটা আমার বড় আর ছোট মেয়ে  হারুর ছোট।  কাকীমার ছিলো খুব সরু গলা,  অনেক বিকেলেই মা আর কাকীমা গান গাইতো এক সাথে, ঠিক যুদ্ধের আগের দিনগুলোর মত।

বাড়ীর  বা দিকটায় থাকতো মাখন কাকার মা।  ওই দিকটাতেই একটা ছাপড়া  ঘরে থাকতো সুধীরদা আর বৌদি। আর আমরা সবাই মিলে  থাকতাম আরেকটা ঘরে।  ওই ঘরের  সামনে ছিল ছোট্ট একটা বারান্দা, যেখানে কাটতো আমার দিন।  আর এই দুই বাড়ীর  মধ্যে ছিল অনেকগুলো ঘর,  এরাও আমাদের মতোই শরণার্থী, কেউ এসেছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে, কেউ ধলেশ্বরী ভাঙ্গনে।  এ সবই ছিল মাখন কাকার জায়গা, মানুষের বিপদ দেখে উনি একটার পর একটা পরিবারকে স্থান দিয়ে গেছেন। অনেক দিন আগে, বছর দুএক তো  হবেই,  একবার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমি যেন কোনো এক বাড়ীর  দুয়ারে খেলছি, দৌড়ে বেড়াচ্ছি এ দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে, আর সুপুরি গাছগুলো আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি  হাসছে।  গত দুই বছরে মনেই করতে পারিনি, কোথায় দেখছি এই বাড়িটি।  গত কাল, যখন আজকের লেখাটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর মনে মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম মাখন কাকার বাড়ির আনাচে কানাচে, হঠাৎ মনে পরে গেলো স্বপ্নের কথা, খুঁজে পেলাম স্বপ্নে দেখা বাড়ীর  ঠিকানা।

মাখন কাকার বাড়ীর  পেছন দিকে ছিল বইরাগীর চক, যে পথ ধরে একদিন আমরা এসেছিলাম বাঙ্গালা থেকে।  প্রায়ই আমরা ঘুরে বেড়াতাম সেই চকে আর ভাবতাম, যদি একটা গরু থাকতো, ঠিক চষে বেড়ানো যেত। আমাদের ঘরের পেছনে ছিল বিশাল এক দেবদারু গাছগাছ আর পাশেই আরেকটা খালের মতো জায়গা।  ওখানে ছিল অনেকগুলো হিজল গাছ। একাত্তরের ওই দিনগুলোতে ছানা  হারুদের সাথে ওই গাছগুলির নিচে খেলতাম  ডাঙ্গুলি, মার্বেল আর চারা।  ওই হিজল গাছগুলো আমার এতো প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে ১৯৮১ সালে যখন আমরা আমাদের গ্রামে প্রথম খেলাঘর আসর করি, ওটার নাম রাখি "হিজল খেলাঘর আসর।"  

মস্কো, ৩০ অক্টবর ২০১৬

Thursday, October 27, 2016

৯. কুদ্দুস ভাই

বাঙ্গালায় যদিও আমরা ছিলাম শশী জ্যাঠামশায়ের (শশী মোহন সেন) বাড়ীতে, আর অনেক সময় কাটতো রাম  মামার সান্নিধ্যে, ওখানে আমরা এসেছিলাম কুদ্দুস ভাইয়ের হাত ধরে, তার আমন্ত্রণে। তাই ওই গ্রামে কুদ্দুস ভাই ই ছিলেন আমাদের প্রথম ও শেষ আশ্রয়। বেশ  উঁচা  লম্বা, প্রশান্ত প্রশস্ত মুখমন্ডল, হালকা গোঁফ  আর নাকের ওখানে কালো বিশাল এক আঁচিল।  মুখে পান আর লালচে দাঁত। এতো বিপদের মধ্যেও তার উপস্থিতি এক ধরণের আস্থার জন্ম দিতো।  তাই সময়ে অসময়ে দৌড়ে চলে যেতাম কুদ্দুস ভাইয়ের ওখানে।  বাইরের বিশ্বের, মানে আশেপাশের গ্রাম বা মফঃস্বল  শহরের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল কুদ্দুস ভাইয়ের মাধ্যমেই। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, তাই মাঝে মধ্যেই তাদেরকে যেমন নিজেদের অবস্থা জানাতে হতো, তাদের কথাও  জানতে হতো।  দেশের  ওই পরিস্থিতিতে এসব করতে হতো গোপনে, বিভিন্ন মধ্যম ব্যবহার করে। আমাদের হয়ে কুদ্দুস ভাই ই এসব করতেন।

কুদ্দুস ভাইর বাড়ী  ছিল গ্রামের ভিতরের দিকে। বাড়ীর পাশেই ছিল ছোট্ট একটা ডোবা বা মাইট্যাল। ওখানে ছিল অনেক বেত।  যদিও বাড়িতে বেতের তৈরী ধামা, কাঠা, মোড়া  -এ সব ছিল,  তবুও  তখন  বেত বলতে বুঝতাম স্কুলের মাস্টারমশাইদের হাতে ছড়ি, পড়া না পারলে যা দিয়ে তারা মারতেন ছাত্রছাত্রীদের।  কুদ্দুস ভাইয়ের ছিল তিন ছেলে, রাশেদ, খালেক।  তৃতীয় জনের নাম মনে নেই।  খালেক আমার বয়সী।  তবে  ওরা  যে খুব বেশী  সময় দিতে পারতো, তা নয়।  বাড়ীর  কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো ওদের।

ওই সময় প্রায়ই মনে পড়তো দেশের বন্ধুদের কথা। পাগলা (পরিতোষ),  সন্তোষ, মনা (মনতোষ) , পানা (প্রাণতোষ), পইড়্যা (পরিমল), মন্টু (মন্তোষ), শঙ্কর, বাদল আরো কত নাম। বাড়িতে যেহেতু আমার কোনো কাজ ছিল না পড়াশুনার বাইরে, দিন কাটতো ওদের সাথে খেলাধুলা করে আর ঘুরে।  ওদের অনেক কাজ করতে হতো।  স্কুল শেষে  খেয়ে যেত ঘাস কাটতে বা গোবর কুড়াতে। ঘাস খাওয়াতো গরু-ভেড়াকে আর গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করতো জ্বালানী  হিসেবে। আমি যেতাম ওদের সাথে। গরু ছিল অন্যের আর গোবর সরকারি, তাই যে আগে গোবর দেখতো বা গোবরের কাছে যেত, তারই হতো গোবর। আমার যেহেতু ওসবের দরকার ছিল না, আমি ওদের হয়ে গোবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম।  আর ওরা  এভাবে গোবর পেয়ে খুশি হতো।  এটা করতাম দুপুরের পর। সকালে ছিল স্কুল।  আমাদের গ্রামে তখন শুধু প্রাইমারী  স্কুল ছিল। তরা  প্রাইমারী  স্কুল। ছোট এক টিনের ঘরে তিনটে মাত্র ক্লাস, তাই ক্লাস  হতো দুই পর্যায়ে, সকাল ১০ টা  থেকে ১২ টা  পর্যন্ত বি, ওয়ান আর টু। ১২.৩০ থেকে ৪ টা পর্যন্ত থ্রি, ফোর, ফাইভ।  স্কুলে ছিল চার জন শিক্ষক - বড় মাস্টারমশায় (হারান সূত্রধর), ছোট  মাস্টারমশায় (অনাথ সূত্রধর), গোবিন্দ স্যার (গোবিন্দ সূত্রধর, বড় মাস্টারমশায়ের ছেলে) আর ঘাড়া স্যার (সরফরাজ স্যার)। বড় মাস্টারমশায় আর গোবিন্দ স্যার আমি প্রাইমারী  স্কুলে পড়ার সময়ই ভারতে চলে যায়।

আজ এই যুদ্ধকালীন সময়ে হাতে যখন অফুরন্ত  সময়, বন্ধুদের কেউই ছিল না পাশে।  এমন কি জানতাম না কে কোথায় আছে? কেমন আছে? বেঁচে আছে কি? প্রায়ই মনে হতো ওদের কথা। আগে যে সব সময় ওদের সাথে শুধু ভালো সম্পর্ক ছিল তা নয়, খেলাধুলা করতে গিয়ে মারামারি হতো প্রায় প্রতিদিন।  প্রায়ই হতো ডুয়েল - পাছার  ধরা, যাকে  বলা যায় ফ্রি স্টাইল লড়াই।  কে কাকে নিচে ফেলতে পারবে। সেই অর্থে ঘুষাঘুষি হতো খুবই কম।  আর ছিল নাক কাটা, মানে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া।  যুদ্ধের দিনগুলোতে মনে হতো, যদি একবার দেখা হয়, আর কখনো ঝগড়া করবো না, মারামারি করবো না।  তবে কথা রাখা হয়নি। যুদ্ধের পর আবার আমরা একসাথে খেলেছি, মারামারি করেছি। তবে স্বাধীনতার পর সবাই দেশে ফেরেনি, বা ফিরলেও বেশি দিন থাকে নি।  রাজেন্দ্ররা চলে গেছিলো কয়েক দিন পরেই।  মনা, পানারা কয়েক বছর পর।  মন্টু, বদলরা এখনো দেশেই আছে।  ভালো আছে সবাই।

কুদ্দুস ভাইয়ের ওখানে যে বেত হতো, তা দিয়ে শুধু বেতই  বানানো যেত না, তাতে বেতুল বলে এক ধরণের ফল হতো। অনেকটা পিচ ফলের মতো দেখতে, তবে আরো ছোট আর খেতে টক, এমনকি তেতোও  বলা চলে।  তবে ওই সময়ে বেতুলও  সুস্বাদু মনে হতো।  এছাড়াও কুদ্দুস ভাইয়ের বাড়িতে ছিল তাল গাছ, আর সেই গাছে ঝুলতো বাবুই পাখির বাসা। আমাদের এলাকায় তাল গাছ তেমন ছিল না।  আমাদের তাল গাছটা ছিল বাড়ী  থেকে অনেক দূরে, বানিয়াজুরীর কাছে জমিতে।  এ ছাড়া ক্রস ব্রীজ  আর  মজুমদার (জমিদার) বাড়ীতে ছিল কিছু তাল গাছ।  শুনেছি ওই গাছে ভুতেরা বাস করতো, আর প্রতি রাতে উড়ে উড়ে ক্রস ব্রীজ  থেকে আমাদের তাল গাছে যেত।  তাই খুব কৌতূহল নিয়ে দেখতাম কুদ্দুস ভাইয়ের তাল গাছ আর জিজ্ঞাসা করতাম, ভুত থাকে কিনা তাদের গাছে।

বাঙ্গালায়  আমরা ছিলাম একমাস বা দেড় মাস।  বাঙ্গালা  থেকে কয়েক মাইল  দূরে ছিল তেরশ্রী গ্রাম।  ওখানকার জমিদার (সাবেক) ছিলেন  সিদ্ধেশ্বর বাবু।  যতদূর জানি, উনি কোথাও পালান  নি। যুদ্ধের সময় ওনার বাড়ীতে  আর্মি ক্যাম্প ছিল।  এটা অবশ্য ওনার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না।  মনে আছে, যুদ্ধের আগে আর তার  পরেও, কম করে হলেও ১৯৮৩ সল্ পর্যন্ত, যখন আমি রাশিয়া চলে আসি, এলাকায় যখনই  কোন পুলিশ বা দারোগা বা থানার কেউ আসতো,  আমাদের বাড়ীতেই  হতো তাদের খাবার ব্যবস্থা।  সেটা আমরা চাই আর না চাই।  এলাকায় প্রবাভশালী হবার, সচ্ছল হবার মাশুল  এটা। এটা  ভালোও নয়, মন্দও নয়, এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা।  জুনের মাঝামাঝি এক সময় খবর এলো তেরশ্রীর পরিস্থিতি ভালো নয়, সিদ্ধেশ্বর বাবু বলতে গেলে গৃহবন্দী। তখনই  কুদ্দুস ভাই যোগাযোগ করলো আমাদের আরেক খরিদ্দার কালু ব্যাপারীর সাথে।  তার বাড়ি ছিল বৈলতলা বলে এক গ্রামে।  সেখানে হারান ব্যাপারী আর আজিজ ভাই নামে  আমাদের আরো পাইকার ছিল।  ওনাদের প্রচেষ্টাতেই আমরা একদিন রওনা হলাম বৈলতলা। বাঙ্গালা  আর বৈলতলার মধ্যে বিশাল বইরাগীর  (জানিনা কেন "রা" এর উপরে জোর দেয়া হয়, কেন বৈরাগীর বলা হয় না )  চক।  সিংজুরীর পাশ দিয়ে হেটে আমরা পৌছুলাম বৈলতলায়।  মাখন কাকার বাড়ীতে।  ঠিক মনে করতে পারছিনা, বাঙ্গালা  থাকতেই অথবা বৈলতলা আসার পরে আমরা খবর পেলাম, তেরশ্রীর  সিদ্ধেশ্বর বাবুকে পাক বাহিনী ঘরে বন্ধ করে পুড়িয়ে মেরেছে।

বৈলতলা আসার পরেও অনেক বার গেছি বাঙ্গালা, কুদ্দুস ভাই স্বাধীনতার পরেও অনেক বছর নিয়মিত আসতো  আমাদের বাড়ীতে। ১৯৮৭ সালে আমি যখন দেশে বেড়াতে যাই মস্কো থেকে, তখনই  মনে হয় কুদ্দুস ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা। উনি আমাকে একটি বাবুই পাখির বাসা উপহার দিয়েছিলেন। আমার হোস্টেলের রুমে ঝুলানো ছিল বাসাটা। হোস্টেল ছাড়ার পরে সাথে করেই নিয়ে এসেছিলাম।   ঘরের জিনিষপত্রের  মধ্যে খোঁজ করলে মনে হয় বাবুই পাখীর  বাসাটা এখনো পাওয়া যাবে।

দুবনা, ২৮ অক্টবর ২০১৬




Tuesday, October 25, 2016

৮. রাম মামা



বাঙ্গালার  দিনগুলো কাটছিলো এক এক করে।  সময় পেলেই দৌড়ে যেতাম বাড়ীর  সামনের মাঠে, কখনো বা পাশের বাড়ী।  এ এক অবাক ব্যাপার।  দেড় মাসও  হয়নি যুদ্ধ শুরুর।  যে সব লোকের সাথে পাশাপাশি বাস যুগ  যুগ  ধরে, সুযোগ পেয়ে তারাই বাড়ী ঘর সব লুট করেছে, মেরে ফেলেছে নিজেদের প্রতিবেশীদের। আর যাদের জীবনে কখনো দেখিনি, যাদের নামও  শুনিনি কখনো তারাই নিজেদের ঘর ছেড়ে দিয়েছে আমাদের থাকার জন্য। শশী জ্যাঠামশায়কে চিনতাম না কোনো দিন, কিন্তু আমাদের বিপদ দেখে কুদ্দুস ভাই আর স্থানীয় চেয়ারম্যান গনি মিঞা আমাদের ডেকে এনেছেন নিজেদের গ্রামে, ওখানে যে পাঁচ-ছয়  ঘর হিন্দু ছিল, তাদের সাথে কথা বলে  শশী জ্যাঠামশায়ের   বাড়ীতে  আমাদের  থাকার ব্যবস্থা করেন ওখানে ঘর-দোর একটু ভালো ছিল বলে।  আমাদের কখনোই মনে হয়নি আমরা পরের বাড়ী  আছি।  মনে হয়েছে যেন নিজেদের বাড়ীতেই  আছি। প্রতাপদা, কালীদিও  সর্বোত ভাবে চেষ্টা করেছে আমাদের উপস্থিতিটা   আনন্দের না হোক, কষ্টের যেন না হয়।

এ  ছাড়াও ছিল কামাক্ষা আর মানিকগঞ্জ থেকে আসা বেবুরা।ওরা  ছিল চার ভাই, সন্তোষদা সবার বড়। এর পর নীলকমলদা, ধ্রুবদা আর বেবু। সন্তোষদা খুব আদর করতো আমাকে।  যুদ্ধের পরে আমরা একসাথে গেছিলাম   ইন্ডিয়া, খুব সম্ভব গোয়ালন্দ গিয়ে দেখা হয়। আমরা ওখান থেকে চলে গেলাম কলকাতা, সন্তোষদা তার বোনের বাড়ী। পরে শুনেছিলাম ওনাকে ওখানে মেরে ফেলা হয়েছিল।  খুব কষ্ট লেগেছিলো খবর শুনে।  যুদ্ধের ওই দিনগুলোতে যাদের সাথে সময় কেটেছে, তারা সবাই যেন আপন হয়ে গেছিলো।

রাম মামা যেন নিজের মামা ছিলেন।  খুব আদর করতেন।  যেহেতু সারাদিন করার কিছু ছিল না, সুযোগ পেলেই দৌড়ে যেতাম তাদের বাড়ী।  যতদূর মনে পরে তাদের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না তখন। বেশ ফর্সা আর লম্বা ছিলেন উনি।  তবে উচ্চতাটা আপেক্ষিক, হতে পারে আমি তখন খুব ছোট ছিলাম বলে ওনাকে এতো বড় মনে হতো।  মনে আছে, সেই ১৯৬৯ আর ১৯৭২ সালে আমার নিজের মামা, অশোক মামাকে দেখে মনে হতো এক পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সামনে।  যেমন উচা লম্বা, তেমনি ফর্সা।  কিন্তু গত ২০১৪ তে যখন কলকাতায় গিয়ে  তার সাথে দেখা হলো প্রায় ৪২ বছর পরে, দেখলাম উনি সেই অশোক মামা নন, যার মুখের দিকে ঘাড়  উঁচু করে তাকাতে হতো, উনি আমারই  মতো একজন, যার সাথে সমানে সমানে কথা বলা যায়, চোখে চোখ রাখা যায়।  কখন যে নিজেই বড় হয়ে গেছি, টেরই  পাইনি।  তাই এখন যদি রাম  মামার সাথে দেখা হতো,  দেখা যেত, উনি আমারই  মতো একজন।

রাম  মামার একটা সাইকেল ছিল আর সাইকেলে ছিল একটা ব্যাগ - নীল রঙের। মাঝে মধ্যে উনি সাইকেলে চড়ে  বাইরে যেতেন, আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন দুনিয়ার খবর। রাম  মামা আমাকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই যেতেন স্থানীয় বাজারে।  তরা  বাজারের মতো এতো বড় নয়, তবে ওখানে যেতে  ভালো লাগতো, যুদ্ধের সময়ও  একটু স্বাভাবিক জীবনের আস্বাদ পাওয়া যেত।

যুদ্ধ কথাটা শুনলেই আমরা আঁতকে  উঠি, অথচ যুদ্ধ জীবনেরই একটা অঙ্গ। জীবনযুদ্ধ কথাটিতো এমনি এমনিতেই আসেনি।  মানব  জাতি যত দিন আছে  এই পৃথিবীতে, ততদিনই আছে এই যুদ্ধ, এই সংগ্রাম।  আগে যুদ্ধ ছিল প্রকৃতির বিরুদ্ধে, এখন শুধু প্রকৃতির বিরুদ্ধেই নয়, মানুষের বিরুদ্ধেও। অথবা মানুষরূপী দুপেয়ে জানোয়ারদের বিরুদ্ধে, যারা মনে করে ইচ্ছে করলেই তারা অন্যদের জীবন নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারবে। এখনো যখন টিভিতে কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে শুনি, চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে, ভাবি কিভাবে মানুষ সেখানে বাস করছে? এইতো এখন দানিয়েৎস্ক এ গৃহযুদ্ধ চলছে, আবার এরই মাঝে দেখি ওখানকারই  কেউ ফটো সাইটে ছবি দিচ্ছে।  প্রথমে একটু অবাক হই  ভেবে, আচ্ছা, ওখানেতো যুদ্ধ, ছবি তোলার সময় কোথায়? তখন  মনে পরে আমার সেই একাত্তরের দিনগুলির কথা।  চারিদিকে যুদ্ধ ছিল, সেই সাথে ছিল জীবন, ছিল ক্ষুধা, ছিল তৃষ্ণা, ছিল মান-অভিমান, ভালোলাগা-ভালোবাসা।  আসলে যুদ্ধ এলে জীবন থেকে কিছুই হারিয়ে যায় না, থাকে সবই আর থাকে ভয়।  শুধু মাত্র ছোট ছোট ভালোলাগা-ভালোবাসাগুলো পেতে  হলে আরো অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়, আরো অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।  শান্তি কোনো শান্ত মানুষের ভাগ্য নয়, শান্তির জন্য লড়াই করতে হয়।  তাই যখনই  বাজারে যেতাম, পেতাম জীবনের আস্বাদ। দেখতাম দেশে শুধু  যুদ্ধই চলছে না, দেশের মানুষ শান্তির জন্য লড়ছে।

একবার রাম  মামা আমাদের নিয়ে গেলো পাকিস্তানের হাটে, তখন অবশ্য লোকজন একে  বাংলাদেশের হাট  বলেই ডাকতো।  ওটা ছিল বাঙ্গালা  থেকে পুব দিকে, যত দূর মনে পরে, আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে গড়পাড়া, মানিকগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়।  তবে ওই জায়গাটা আমাদের কাছে পরিচিত ছিল ঘাড়া  স্যারের কারণে।  ঘাড়া  স্যার - মানে আমাদের প্রাইমারী  স্কুলের সরফরাজ স্যার, উনি পড়া না পারলে বেত গিয়ে মারতেন না, স্কেলের  ধারালো দিক দিয়ে মারতেন।  ও থেকেই ছাত্রদের কাছে উনি ঘাড়া  স্যার নামে  পরিচিত।  অনেকদিন পরে  কোনো পরিচিত লোকের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনায় বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলাম, যদিও জানতাম না এমন দেখা ভালো হতো না মন্দ।  রাম  মামা অবশ্য বলেই দিয়েছিলেন কোনো মতেই  যেন না বলি আমরা কোথায় থাকি।  যদিও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এই হাট  ভ্রমণে, তার পরেও খুবই ভালো লেগেছিলো অনেক দিন পরে এলাকা থেকে বেরুতে পেরে, অনেকটা স্বাধীন স্বাধীন মনে হচ্ছিলো নিজেকে।  এর পরে আমরা বাঙ্গালা  আর বেশিদিন ছিলাম না। তবে রাম  মামার সাথে যোগাযোগ ছিল স্বাধীনতার পরেও।  রাম  মামা মানিকগঞ্জ চাকরী  করতেন, সময় পেলেই আসতেন আমাদের বাড়ীতে।  মনে হতো খুব আপন কেউ বেড়াতে এসেছেন।  মা খুব আদর করে খাওয়াতো তার ভাইকে।  তবে স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই মানিকগঞ্জ যাবার পথে এক ট্রাক একসিডেন্টে মারা যান আমাদের রাম  মামা।

দুবনা, ২৬ অক্টবর, ২০১৬


Wednesday, October 19, 2016

৭. বাঙ্গালার দিনগুলি

শশী জ্যাঠামশায়দের বাড়ীটা তেমন বড় না হলেও খুব যে ছোট তা নয়।  তবে ঘরের সংখ্যা কম।  আমাদের বাড়িতে বড় বড় ঘর ছিল গোটা বিশেক, তাই দু-তিনটে ঘর আমার কাছে খুব কম বলেই মনে হতো।  বাড়ীটা  ছিল একেবারে চকের  সাথে ঘেঁষা, সামনের দিকটায় পালান, যেখানে বেগুন, মরিচ এসব লাগানো। পেছন দিকে ঘরগুলো, যার একটায় ঢালা বিছানায়  ঘুমাতাম আমরা সবাই।  বাড়ীর  সামনে দিয়েই চলে গেছে গেঁয়ো  পথ, মাঠের ভিতর দিয়ে একে বেঁকে।  রাস্তাটা ঠিক আমাদের গ্রামের রাস্তার মতো নয়, যেখানে মাটি তুলে একটু উঁচু করে সেটা তৈরী।  এটা ছিল জমিজমার মধ্য দিয়ে মানুষ আর গরু-ঘোড়ার চলাচলে তৈরী হওয়া  প্রাকৃতিক রাস্তা।  ওর একটা শাখা চলে গেছে পাশের   গ্রামে সিংজুরী যার নাম, অন্যটা সামনের দিকে সোজা গিয়ে উঠেছে গ্রামের ছোট্ট বাজারে।
বাড়ীর  সামনেই রাস্তার ঠিক ওপারে ছিল একটা ডোবা যাকে  আমরা বলতাম মাইট্যাল।  পুকুর যদি কাটা হয় পরিকল্পনা করে মাছ ছাড়ার জন্য বা জলাশয় হিসেবে, সেখানে মাইট্যাল  খোঁড়া হয় আসলে অন্য কোনো কাজে মাটির জন্য, আর এর ফলে যে গর্ত তৈরী হয় সেটাই ধরে রাখে  বর্ষার বা বৃষ্টির জল। অনেক ক্ষেত্রে এসব হয় মশা উৎপাদনের কারখানা। আমরা যখন বাঙ্গালা  ছিলাম, এটা ছিল জ্যৈষ্ঠ মাস, তখন ওখানে জল ছিল।  আমার এখনো মনে আছে ওখানে ডুব দিয়ে স্নান করার কথা।  আর ওই ডোবাটার চারদিকে ছিল হাগড়া  বন।  হাগড়া এক ধরণের আগাছা যাতে ছোট ছোট কাঁটাওয়ালা ফল হয়। সেই ফলগুলো আমরা একে অন্যের মাথায় ছুড়ে মারতাম, আর ওগুলো আটকে পরতো  চুলে।
শশীজ্যাঠামশাইদের বাড়ী  ছিল আলাদা, অন্যদের বাড়ি যেতে হতো ছোট এক টুকরো নিচু জমি  পেরিয়ে। ওদিকে থাকতো বেশ কয়েক ঘর লোক।  রাম  মামা ছিলেন তাদের একজন। খুব সহজেই মার সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো, তাই সময় পেলেই আমি দৌড়ে চলে যেতাম ওদের বাড়ী।  বাঙ্গালায়  থাকাকালীন  ফিরে এলো দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই।  আবার মা বিকেলে বই পড়ে  শোনাতো বা প্রার্থনার গান করতো। বাড়ীতে  থাকতেও অনেক কিছুই হতো মাকে ঘিরে।  ওই সময় গ্রামের মহিলারা লেখাপড়া খুব একটা জানতো না।  মা লেখা পড়া জানতো, তাই প্রতি বিকেলেই শাস্ত্র (আমরা বলতাম শাস্তর) পড়া ছিল মার কাজ।  বড়মা, জেঠিমা, মেঝমা, খুড়ীমা  সহ  পাড়ার মহিলারা বিকেলে বসতো  বড়দাদের বারান্দায়। গরমের দিনে পাখা হাতে আর শীতের সময় মালসায় (এক ধরণের মাটির পাতিল) করে কয়লার আগুন  নিয়ে। কেউ বাড়তো চুল, কেউবা বাছতো  উঁকুন।  সাধারণতঃ  পড়তো রামায়ণ বা মহাভারত আর গাইতো
ভব সাগর তারও কারণ হে, রবি নন্দন বন্দন .........

তা ছাড়াও অনেক মহিলারা নিয়ে আসতো  চিঠি আর মা সেসব পড়ে  শুনাতো।  অনেকে চিঠি লিখে দেবার জন্য আসতো  মার কাছে।  মা শুধু নিজেই পড়াশুনা করেন নি, আমাদের বাড়িতে মেয়েদের পড়াশুনার  আর গান বাজনার রেয়াজ চালু করে।  মার কারণেই আমরা গান শিখতে শুরু করি।  গান শিখতো  দিদি, রতন।  আমিও গাইতাম, তবে

ওগো নদী  আপন বেগে পাগল পাড়া .....

এর বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়নি।  রঞ্জিতদা, কল্যাণদা তবলা বাজাতো, পরে আমিও তবলা বাজাতে শিখতাম।  এখন শুধু মাত্র রতন গান  করে,  গান শেখায়। আমাদের বাড়ীতে  দিদি বাদেও ছিল তিন কাকাতো বোন।  দুজনের বিয়ে হয়েছিল আমার জন্মের আগেই, বয়েস  খুব বেশী  হবার আগেই।  মা দিদিকে পড়িয়েছে, তবে বিয়ে আর দেয়া হয় নি।  দিদি মাস্টার্স শেষ  করে এখন স্কুলে পড়ায়।  সুধীরদা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে বিয়ে করে বৌদি মাত্র মেট্রিক পাশ করেছে।  আসলে মামা বাড়ী  বেড়াতে যাবার সময় বৌদিকে পড়াতে গিয়েই প্রেম, পরে বিয়ে।  এখনো মনে আছে ১৯৬৯ এ কলকাতা যাবার আগে মির্জাপুর মামা বাড়ী  গিয়ে সুধীরদার জন্য  পুতুল নামের এক মেয়ে দেখা হয়েছিল।  ওর নিজেরই পছন্দ।  আর পি সাহার ওখানে গিয়ে দেখা, হোমসের ছাত্রী।  পরে যখন কলকাতা থেকে ফিরে  আসি, শুনলাম  সুধীরদা মত  পরিবর্তন করেছে, বিয়ে করবে হোমসেরই  আলতা নামে  এক মেয়েকে।  কাকাদের মত  ছিল না, মূলতঃ   ওই পরিবার নিম্নবিত্ত ছিল বলে। মা শুনে বললো, আমাদেরতো টাকার বা যৌতুকের দরকার নেই, আমার ছেলে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে।  বাড়ী  থেকে বড়দের  কেউ যায়নি ওই বিয়েতে।  বাবা এমনিতে কোথাও যায় না, সাধারনতঃ  ছোট কাকাই যায়। এবার বড় দা গেলো সবার দায়িত্ব নিয়ে। বিয়ে হলো নিজেদের খরচে, নিজেদের মতো করে।  বৌদি ঘরে এলে মা বললো বৌমা  পড়াশুনা করবে। কাকারা খুশী  হয়নি শুনে, মার  কথা, আমার বৌমা, আমি দেখবো সে কি করে।  শেষ পর্যন্ত মাই জিতলো, বৌদি মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করলো গার্লস স্কুলে।  এই হলো মা।  ঘুরতো প্রচুর, তীর্থ থেকে তীর্থে যেত, বই পড়া, সেলাই করা, রান্না বান্না - কি বা না করতো।  আমরা এতো গুলো ভাইবোন - তার পরেও কেমনে যেন সব করে উঠতো। তাই মাইল্যাগী  থাকাকালীন  অনেকটা গৃহবন্দী থেকে এখানে এসে যেন প্রাণ ফিরে  পেলো।  আবারো বই নিয়ে বসলো বিকেলে।  ঘুরতে গেলো রাম মামাদের বাসায়।  শুরু হলো নতুন জীবন।

শুধু মার  কেন, আমাদেরও। আবার শুরু হলো বাজারে যাওয়া, পাড়া  বেড়ানো।   রাম মামা ছাড়াও দৌড়ে চলে যেতাম কুদ্দুস ভাইয়ের ওখানে।  তার ছেলে খালেক ছিল আমার সমবয়েসী।  তবে সমস্যা  হলো, আমি ছিলাম বাড়ী থেকে দূরে, কাজকর্ম হীন, সারা দিন ছিল শুধুই ঘুরে বেড়ানোর জন্য, আর খালেক ছিল বাড়ীতে, চাক আর নাই চাক, ওকে কাজ করতে হতো, বাড়িতে সাহায্য করতে হতো।  তাই আমার মত  অফুরন্ত সময় ওর ছিল না।  তবে কিছু দিন পরেই চলে এলো বেবুরা। ওরা  মানিকগঞ্জ থেকে এসেছে।  আমার বয়সী, তবে একটু টিউব লাইট জাতীয়।  এখনো তাই।  যুদ্ধের পর আমাদের যখন মানিকগঞ্জে কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয়, পাশের দোকানটাই বেবুরা  কেনে।  মানিকগঞ্জ গেলে দেখা হতো, তবে তেমন কথা হতো না।  তবে কলেজে পড়ার সময় যখন ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর, উদীচী - এসবের সাথে জড়িত হই, তখন ওর বড় ভাই দ্রুবদার  সাথে  ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেটা আজও  টিকে আছে। আর কামাক্ষা তো ছিলই।  বাঙ্গালা  বলতে গেলে ছিল যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে।  বাড়ী  থেকে মাঝে মধ্যেই আসতো  সালাম ভাই চাল-ডাল নিয়ে।  সামসু চাচারা কায়দা করে জমির ফসল আর তা বিক্রি করা টাকা পাঠাতো সালাম ভাইকে দিয়ে।  সালাম ভাই গ্রামের খবর নিয়ে আসতো।  আশাবাদী তেমন কিছু নয়, তার পরেও সামসু চাচা, নোয়াই চাচা, সালাম ভাই এদের বন্ধুত্ব, এদের কৃতজ্ঞতা সবার মনে আশা জাগাতো।  বাবা মাকে বলতে শুনতাম এরা  যতদিন আছে, শত দুঃখের মাঝেও বেঁচে থাকবে আশা, বাড়ী  ফিরে যাবার আশা।

দুবনা, ২০ অক্টবর ২০১৬




Saturday, October 15, 2016

৬. মাইল্যাগী থেকে বাঙ্গালা

আগেই বলেছি মাইল্যাগী  আমরা ছিলাম এপ্রিলের ৮ তারিখ থেকে মাসের শেষ  বা মে'র প্রথম পর্যন্ত।  বাঙালী  হিন্দু পরিবার খ্যাত তার বারো মাসে তের পর্বনের জন্য।  এই সব পার্বনের কিছু কিছু একান্ত পারিবারিক, যেখানে পুরোহিতের দরকার হয় না। যেমন নাটাই পূজা, বসুমতী  পূজা, সুবচনী পূজা। আবার কিছু কিছু একান্তই সামাজিক, যখন ঢাক-ঢোল বাজিয়ে পুরোহিত এনে তা করতে হয় - যেমন দূর্গা পূজা, কালী পূজা, স্বরস্বতী পূজা।  নানা বর্ণে বিভক্ত হিন্দু সমাজে কিছু পূজা যেমন অপেক্ষাকৃত উচ্চ বর্ণে ও আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারে সীমাবদ্ধ, ঠিক তেমনি কিছু অনুষ্ঠান নিম্ম বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে দেখা যায়। অন্তত আমাদের এলাকায় সেটাই দেখে এসেছি সেই ছোটবেলা থেকেই।  ইদানিং কালে অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে উপরের দিকে অনেক পূজা-পার্বন জেলে বা অন্যান্য নিম্ন বর্ণ হিন্দু সমাজে ঢুকে গেলেও চৈত্র পূজা এখনো উপরের দিকে উঠে আসেনি।

চৈত্র পূজা হতো চৈত্র মাসে - বেশ কয়েক দিন ধরে শিবের কাঠাম (কাঠের তৈরী মূর্তি) নিয়ে  ঘুরতো ভক্তরা বাড়ী  বাড়ী , গ্রামে গ্রামে।  সংগ্রহ করতো চাল, ডাল, শাক-সবজি, টাকা পয়সা আর রাতের বেলা হতো নাচ - ভুত-পেত্নীর নাচ।  এই পূজা চলতো বেশ কয়েক দিন আর শেষ হতো চৈত্র সংক্রান্তির দিন।  এর সাথে বান  দেয়া (এর ফলে যারা নাচতে নামতো ভুত বা পেত্নীর বেশে  তাদের মৃত্যুও হতো বলে কথিত আছে) সহ  আর কত যে ভৌতিক গল্প জড়িত ছিল, তার ইয়ত্তা নেই।  এটা অনেকটা শিয়াদের  মহরমের মতো - যখন ঢাল-তলোয়ার নিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ছুটতো  মানুষ। তবে মহরম হতো দিনে, আর চৈত্র পূজা দিন-র্যাপ ব্যাপী।  পরিচিত এই মানুষগুলো রাতের বেলায় যখন খড়গ হাতে নাচতে নামতো, দেখে মনে হতো, ওদের যেন হুশ নেই।  আমরাও, পাড়ার ছেলেরা, বাঁশের  তলোয়ার তৈরী করে নাচতাম আর সেটা পূজার আগে আর পরে অনেক দিন পর্যন্ত ব্যাপৃত থাকতো।  এই প্রথম আমাদের জীবনে চৈত্র পূজা এলো না।  আর এই প্রথম সেই খেলার সাথীগুলোর  দেখাও মিললো না।

তবে চৈত্র পূজার দিনগুলোতে  আমাদের বাড়িতে সবাই ব্যস্ত থাকতো আসন্ন হালখাতার অনুষ্ঠানকে ঘিরে।  ওই সময় আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ এতো জাকজমক করে পালন করা হতো না।  ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরের কথা জানি  না,  তবে আমাদের গ্রামে এটা  সীমিত ছিল মূলতঃ  হ্নিদু পরিবারগুলোর মধ্যে।  দূর্গা পূজার পরে  বিজয়া দশমীর মতোই (আসলে ওটা ঘটতো  পরের দিন, প্রতিমা বিসর্জনের পরের সকালে)  নববর্ষের  দিন আমরা সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম, প্রণাম করতাম বড়দের  (শুধু বয়সেই নয়, সম্পর্কে, গোত্রে), কোলাকুলি করতাম সমবয়সীদের সাথে (যেমনটা ঘটে ঈদের সময়) . বাতাসা  বা অন্যান্য মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতো অতিথিদের।  আর আমাদের বাড়ী  হতো হালখাতা।  সকালে উঠে গুদাম ঘরে  গণেশের মূর্তি আর হাঁড়ির উপর নারকেলের সামনে  যে তামার বিশাল থালা পাতা থাকতো, তাতে শব্দ না করে ফেলতাম পাকিস্তানী সেই এক টাকার মুদ্রা।  তারপর সারাদিন দিন  চলতো খরিদ্দারদের আসা যাওয়া।  সবাই পুরানো বছরের বকেয়া শোধ করতো, নতুন বছরে নতুন করে খোলা হতো খাতা।  এই উৎসবের মূল খাবার ছিল দই, মুড়কি (গুড়ের সিরাপে ভেজানো খৈ) আর নানান রকম মিষ্টি।  আমার ঠিক মনে পড়ছে না, এই দিন  ভাতের ব্যবস্থা ছিল কি না? মহানামব্রত বহ্মচারীর পাঠের পর যে মহোৎসব হতো তার মূল খাবার ছিল লাবড়া আর খিচুড়ি, বিভিন্ন রকমের ডাল  আর সবজি, আবার  কোনো কোনো উৎসবে খাওয়ানো হতো বিভিন্ন রকমের মাছ (মাংসের আগমন তখন হয়নি বাড়িতে, আমরা নিজেরাই খেতাম লুকিয়ে), ঠিক তেমনি হালখাতার ছিল নিজস্ব মেন্যু। আমাদের বিশাল বাড়ীর  দুয়ারে অনেকগুলো লাইন ধরে মানুষ বসে পড়তো খেতে, খেলো কলার পাতায়।  খেয়াল করতাম, হিন্দুরা খেত পাতার উপরের সবুজ দিকে, মুসলমানরা নিচ দিকে, মানে উল্টো দিকে। ওরা  বলতো, ওই দিকতা পাখিরা নোংরা করতে পারে না। এখনকার মতো চেয়ার, টেবিল, প্লেট-গ্লাস ভাড়া করার সুযোগ তখন ছিল না।  আসলে তখন খুব কম লোকই এসব অনুষ্ঠান করতে পারতো, তাই এসব ব্যবসা তখন লাভজনক ছিল না।  এই প্রথম বারের মতো হালখাতা আমাদের পাশ কাটিয়ে গেলো।  বাড়ি থেকে দূরে দৈনন্দিন জীবনে ছোটোখাটো পরিবর্তন হলেও দিন  চলছিল নিজস্ব গতিতে, তবে যেসব  অনুষ্ঠানগুলো জীবনের অংশ হয়ে গেছিলো, তা না হলে মনটা বিষন্ন হতো, তখন সবাই বিশেষ করে, বেশী  করে বুঝতে পারতাম সেই অস্বাভাবিক সময়ের উপস্থিতি।

মাইল্যাগীতে  আমার সমবয়সী কেউ ছিল কি? কেন যেন মনে হয় ছিল, যদিও কোনো চেহারা বা নাম  কখনোই আমার মনে উঁকি দেয়  নি।  আমি নিজে অবশ্য খুবই অন্তর্মুখী। সব সময় নিজের জগতে ব্যস্ত।  মনে আছে, অনেক পরে যখন মস্কোয় প্রায়ই আড্ডা দিতাম, ঠিক কখন যে আমি কোন একটা বই বা কিছু একটা নিয়ে হারিয়ে যেতাম নিজের মধ্যেই। এখনো হয় হামেশাই সেটা হয়।  কাজ আশপাশ দিয়ে পরিচিত লোক চলে যাচ্ছে, আমি খেয়ালই  করিনি।  আমার মনে হয় ওই যুদ্ধের সময় আমি মার্বেল নিয়ে কোথাও বসে বসে খেলতাম, আর স্বপ্নের ঘোরে কাটিয়ে দিতাম দিনের পর দিন।

তারপর একদিন ডাক এলো চলে যাবার। কুদ্দুস ভাই এলো আমাদের নিতে।  গন্তব্য বাঙ্গালা।  এটা  তেরশ্রীর  অদূরে ছোট এক গ্রাম, পয়লা আর সিংজুরী ইউনিয়নের প্রান্তে।  আমার এখনো মনে আছে ফসলে জমির মধ্য দিয়ে হেটে যাবার কথা।  কখন বা মা বা কারো কোলে, আবার কখনো কুদ্দুস ভাইয়ের সাইকেলে।  ঢাকায় পাক হানাদারদের আক্রমণের   পরের দিন যেমন মানুষ দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটছিল, এবার তেমনটি ছিল না।  আগে থেকে হিসেবে কষে ধীরে সুস্থে গন্তব্যের দিকে যাওয়া, যদিও চেষ্টা ছিল যতটা সম্ভব অন্যদের অগোচরে এলাকা ত্যাগ করা।  মাইল্যাগী  ছাড়ার মধ্য দিয়ে বাড়ির সবাই স্বীকার করে নিলো এই যুদ্ধটা যে  দীর্ঘস্থায়ী হবে, বাড়ী  ফেরা যে খুব সহজে হবে না সেই কঠিন আর মর্মান্তিক বাস্তবতা।

বাঙ্গালা  আমরা উঠলাম শশী জ্যাঠামশায়ের বাড়ীতে।  সেন বাড়ী  নামেও পরিচিত।  তার ছেলে ছিল প্রতাপ দা, আর মেয়ে কালী দি। কালী দি ছিল খুবই ফর্সা, তাই কেন যে তার নাম কালী রাখা হয়েছিল, সেটা গবেষণার ব্যাপার বটে।  পাশের বাড়ী  ছিল তারকেশ্বর বাবুর। তার ছেলে ছিল কামাক্ষা - খুব লাগতো আমার পেছনে। একবার পেট  খারাপ হলে আমাকে দেখলেই হেরে গলায় গাইতো

আমার হয়েছে  আমাশা
হাগতে গেলে সাউ পরে অষ্ট  নয় মালসা

তার পরেও ওর সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।  এছাড়া ছিল কুদ্দুস ভাইয়ের ছেলে খালেক আর রাম মামা।  তবে সে সব কথা পরে।

মস্কো, ১৫ অক্টবর ২০১৬



Wednesday, October 12, 2016

৫. মাইল্যাগী - ফিরে দেখা

আমি বাড়ীর ১৭ ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট।  যদিও ১৯৭০ এ কলকাতায় সুবোধদার ছেলে বাপীর  জন্ম হয়, ১৯৭৫ এ ভ্রমরের জন্মের আগে পর্যন্ত বাড়িতে ছিলাম আমিই সবার ছোট, সবার আদরের। ছোট হওয়ায় এক আধটু বকা-ঝকা শুনলেও আদরটাই মেলে খুব বেশী  করে, অন্ততঃ  আমার তাই মনে হয়। তাই এখনো সেভার  প্রতি আমার একটু পক্ষপাতিত্ব থেকেই যায়, মনিকা, ক্রিস্টিনা সেভার  প্রতি আরেকটু বেশী  উদার হোক, এটাই চাই, ফলে মাঝে মধ্যে আমাকেও ওদের বকা খেতে হয়।  তবে ছোট হওয়ার আরেকটি সুবিধা হলো, যখন অতীতের কোনো ঘটনা কল্পনা আর বাস্তবতার একটা পাঁচমিশালী  মনে হয়, বড়দের  কাছ থেকে  তার সত্যতা বা অসত্যতা জেনে নেয়া যায়।  তবে লেখাটা যেহেতু আমিই লিখছি আমার স্মৃতি থেকে, তাই অনেক ক্ষেত্রেই  ওরা  একটা লেখা পড়ার পর মন্তব্য করতে পারে, ঘটনা সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য আমাকে দিতে পারে। তাই মনে হয় আমার এ স্মৃতিচারণ নিউটনের সূত্র মেনে সমগতিতে  সরল পথে এগুবে না, বরং রথের মেলার ভীড়ের ধাক্কায় কখনো সামনে এগুবে, কখনো বা পিছু হটবে।  তবে বাস্তব জীবনে সব এভাবেই ঘটে, তাই আশা করি পাঠক একটু ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে সামনে এগুবেন।

আমার মনে হয়েছিল মার্চের শেষের দিকেই আমরা বাড়ী  ছেড়ে চলে গেছিলাম, কেননা তরার  শেষ দিনগুলো আমার তেমন মনে পড়ছিলো না। যতদূর মনে আছে সবাই ভীড়  করে আকাশবাণী আর বিবিসি শুনতো আর আলোচনা করতো কি ঘটতে যাচ্ছে দেশে।   কাল কল্যাণদা  বললো,  ৭ ই এপ্রিল মানিকগঞ্জের আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে শুরু করলে সবাই আসন্ন আর্মি আসার আভাষ  পায়, তাই ৮ই  এপ্রিল  আমরা বাড়ী  ত্যাগ করি।  আমাদের যাবার যে খুব বেশি জায়গা ছিল তা নয়।  আমার মনে আছে, দেশে  আমরা হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় মাত্র বেড়াতে যেতাম। ঝিটকা  ছিল আমাদের পিসি বাড়ী, যাতায়াতের অসুবিধার কারণে আমরা যেতাম বর্ষা কালে, নৌকা করে।  রাস্তায় কিছুক্ষেনের জন্য মন্টুদাদের  বাড়িতে নেমে দুপুরে  খেতাম। ঝিটকায়  অনেকেই ছিল আমার সমবয়সী, সময় তাই ভালোই কাটতো। ওখানে সিন্ধি নারকেল ছিল খুব প্রিয়, নারকেল গুলো ছিল একটু হলদেটে, আর প্রিয় ছিল ওখানকার হাজারী খেজুরের  গুড়। বাবা শনিবার করে ঝিটকা হাটে  আসতো, তাই পিসিবাড়ী  গেলে বাবার ওখানে যেতাম শনিবার।  এছাড়াও যেতাম ঝিটকা জমিদার বাড়ী , আমাদের মামা বাড়ী, তত  দিনে অবশ্য    ওটা বেদখল হয়ে গেছিলো। এছাড়া কালে ভদ্রে যেতাম বাগজান মাসী  বাড়ী, এটা ঢাকা-আরিচা রোডের পাশেই।  মির্জাপুর যেতাম কখনো সখনো, ওখানে আমাদের বড় মামা থাকতো, মার্ জ্যাঠাতো ভাই।  তখন যেতে হতো ঢাকা হয়ে। প্রথমে তরার  ঘাট পার হয়ে ইপিআরটিসির বাসে  নয়ারহাট, সেখানে আবার নদী  পার হয়ে আমিন বাজার পর্যন্ত বাসে, আবার ফেরী , তারপর   বাসে  গুলিস্থান।  সেখান থেকে কমলাপুরের ওদিক দিয়ে জয়দেবপুর, কালিয়াকৈর ঘুরে তবে মির্জাপুর।  সেখানেও ছিল একগাদা ভাইবোন। মার্ সাথে গেলে মা সব সময় রণদা প্রসাদ সাহার সাথে দেখা করতো, আমাদের কেমন যেন লতায় পাতায় আত্মীয় ছিলেন, উনি যখন সেই বিখ্যাত কুঁড়ে  ঘরে এসে বসতেন,  মা যেত দেখা করতে আমাকে নিয়ে।  একবার আমরা গেলাম তাদের কোন এক বাসায়, ঠিক মনে নেই, টাঙ্গাইল না হোমসে, যেখানে শোকেসে  ছিল বেশ কয়েকটা বড় বড় জাহাজ, আমি খুব ঘুরে ফিরে  দেখতে শুরু করলে কে যেন বললো, "নিবে?" মা বললো, "দিদি দরকার নেই, এটা টানা কষ্ট এখন থেকে, ওর বাবা কিনে দেবে।"   মনে হয়, ওটা যেখানে সেখানে পাওয়া যেত না, তাই বাবা আর কিনে দেয়  নি।  এছাড়া আমরা যেতাম ফরিদপুর জগদবন্ধু  আশ্রমে, কি একটা মেলায়।  ওখানে আমার প্রিয় ছিল পাঁপড়  ভাজা আর মাটির বিরাট চিংড়ি মাছ। ফেরীতে  করে  পদ্মা পার হতাম, মাঝে মা দেখাতো কোথায় পদ্মা আর যমুনা মিশেছে। ওই সময় মহানামব্রত বহ্মচারী বছরে একবার আমাদের বাড়ী আসতেন ভাগবৎ  পাঠ করতে।  অনেক লোক হতো। উনি খুব ভালো বলতেন।  এখন যখন বিভিন্ন ধর্মীয় জমায়েতে অন্য ধর্মের মুণ্ডুপাত করাটাই আসল, উনি শুধু ভববানের মাহাত্ম্যই বলতেন কোনো ধর্মের সমালোচনা  না করে। এই একটা অনুষ্ঠান, যেখানে বাবা উপস্থিত থাকতো। যুদ্ধের শেষ দিকে ফরিদপুরের মঠ বোমা ফেলে ভেঙে দিলে যত দূর জানি উনি শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেছিলেন মঠটাকে পুনর্নির্মাণ করতে, সেটা বঙ্গবন্ধু করতে রাজী  হননি, ফলে মহানামব্রত ব্রহ্মচারীও আর দেশে ফিরেন নি। আমি  ১৯৭২ সালে তাকে শেষ দেখেছি কলকাতায়, খুব সম্ভব মানিকতলায়।  এর পর বাড়িতে আর ভাগবৎ পাঠ  হয়নি।  যদিও  রামমঙ্গল, পদাবলী, জারীগান এসব আমাদের বাড়ীতে  আরো অনেক দিন পর্যন্ত হয়েছে।

তবে আমরা এসব কোনো জায়গায় না গিয়ে গেলাম মাইল্যাগী, সুধা  পিসিদের বাড়ী। ওটা ছিলো  ঘিওরের পাশেই, রাস্তার উপর।  তখন আজকালকার মত  রাস্তাঘাট ছিল না, ওখান দিয়ে মানুষ হাটতো, কখনো  যেত ঘোড়ার গাড়ী।  যেহেতু আমরা ছিলাম বিশাল পরিবার, তাই সবাই একসঙ্গে থাকা ছিল দুরূহ কাজ।  ফলে একদল চলে গেলো ঘিওর বড়দির বাসায়। আমাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় বড়দি   বা  কালীদি।   ওনার ছেলে দিলীপ মামা আমার থেকে বছর দশেকের বড়, ভালো গান গাইতো। মেয়ের বিয়েও আগেই হয়ে গেছিলো।  আমরা বড়দির ওখানে বেড়াতে যেতাম, তবে আমার ভালো লাগতো না।  ওনার ছিল শুচি  বাই, অনবরত হাত -পা ধুত, ফলে হাতে-পায়ে ঘাঁ  শুকাতো না কখনো।  জামাইবাবুকে দেখিনি।  শুনেছি,  কলার খোসায় পা পিছলে পরে মারা যান।  এমনিতে ডাক্তারী  করতেন।  উনি ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ভাস্তে।  কল্যাণ দাও কাকাদের সাথে ওখানেই চলে গেছিলো, তবে ছিল মাত্র দু-তিন দিন, কেননা প্রায়ই রব উঠছিলো আর্মি আসলো বলে।  পরে ওরা  তেরশ্রী হয়ে চলে যায়  দৌলতপুর দাদু বাড়ী।

মাইল্যাগি আমরা ছিলাম এপ্রিলের শেষ বা মে  র প্রথম পর্যন্ত। আমার তেমন মনে পরে না সেই দিন গুলো।  মনে আছে, একটু সুযোগ পেলেই রাস্তায় গিয়ে মার্বেল খেলতাম। তবে যেহেতু বাড়ী  ছিল রাস্তার উপর, আর ভয় ছিল অন্যদের নজরে আসার, তাই বেশির ভাগ সময় বাড়ীর  ভেতরেই লুকিয়ে থাকতাম।  এটাকেই বলে পালিয়ে গিয়ে পালিয়ে থাকা। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, যতদিন আমরা মাইল্যাগী  ছিলাম, সবার ধারণা ছিল আর মাত্র কয়েকটা দিন, গন্ডগোল থেমে  যাবে, আমরা আবার বাড়ী  ফিরে যাবো।  বাড়ীতে  তখন যুদ্ধ শব্দটা আসেনি, এটা ছিল সাময়িক গন্ডগোল, যেটা চল্লিশের দশক থেকে বার বার ঘটেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপে। তবে যখন গ্রামের হিন্দু বাড়ীঘর  লুটের খবর এলো, আর খবর এলো পরেশ কাকা সহ  বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর খবর সবার মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।

এতদিন যে মৃত্যুর খবরগুলো আসতো, তা ছিল শুধুই মৃত্যু, অবয়বহীন। শুনতাম হাজারে হাজারে মানুষ মরছে, সেই মানুষ গুলোকে কল্পনা করতে পারলেও তাদের কোনো নির্দিষ্ট চেহারা ছিল না। আমার এই ছোট্ট জীবনে বলতে গেলে কোনো মৃত্যু দেখিনি।  ১৯৭০ এ আমার এক ঠাকুরমা মারা যায়।  অনেক বুড়ো ছিল।  আমায় জন্মের পর থেকেই তাকে দেখেছি ঘরে পড়া, নয়াবাড়ীর ঠাকুরমা।  তাই বলতে গেলে আমার কাছে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একদিন   দেখলাম বোম্বাই আম গাছের নিচে চিতা জ্বালিয়ে তাকে পোড়ানো হচ্ছে, শুধু কিছুদিন ভয় পেতাম ওই  গাছের আম  পারতে।  আর এখন যারা মারা গেলো, তাঁরা  সবাই পরিচিত।  পরেশ কাকার বাড়ী  আমাদের দু বাড়ী  পরে। চালের দোকান করতো। তার ছেলে পরিমল আমার মার্বেল খেলার সাথী, মেয়ে  কল্পনা-আল্পনা - ওদের সাথে ছি বুড়ি  খেলতাম।  মাত্র কদিন আগে ওদের আরেকটা ভাই হয়।  তাই ওরা  ছিল আমাদের জীবনেরই একটা অংশ।  নিরা কাকা, জগা কাকা  দাদাদের সমবয়সী, প্রায়ই বেড়াতে আসতো। মা ডাকতো ওদের চা খেতে।  টি স্টলে  চা পাওয়া গেলেও গ্রামে খুব বেশি বাড়ীতে  তখন চা হতো না, আমাদের চা হতো বেশ কয়েক বার, কেউ এলেই চা, মুড়ি এসব দিতো। রমেশদা  আমাদের খদ্দের।  বলাই গোসাই প্রায়ই আসতো।  আসলে এসব মুখগুলোই ছিল খুব পরিচিত।  তাই বলতে গেলে একাত্তরের  মৃত মানুষগুলো এই প্রথম চেহারা পেল  আমার  বা আমাদের কল্পনায়।  আমরা মৃত্যুর মুখ দেখলাম। এর সাথে সাথে ভেঙে গেলো দ্রুত বাড়ি ফেরার আশা।  তাই যখন মাইল্যাগী এলাকার চেয়ারম্যান আমাদের এলাকা ছাড়তে বললো, আর কুদ্দুস ভাই বললো তাদের ওখানে যেতে, আমরা চললাম নতুন অনিশ্চয়তার পথে।  

দুবনা, ১২ অক্টবর ২০১৬



Tuesday, October 4, 2016

৪. ঘর ছাড়ার পালা

আসল গল্পে যাবার আগে দুটো কথা বলে নেয়া ভালো। যখন আমি লেখা শুরু করি, মনে হয়েছিল একাত্তরের স্মৃতিগুলোই শুধু বলে যাবো।  লিখতে গিয়ে বুঝলাম ব্যাপারটা এতটা সহজ নয়। বয়স খুব কম থাকায় তখন আর যাই থাকে, কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার বুদ্ধি ছিল না। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি, নিজের অজান্তেই আমি সেই সব ঘটনাগুলোর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করতে চাইছি। আর সেটা হচ্ছে আমার বর্তমান বিশ্ব দর্শনের ভিত্তিতে। তাই এটাকে ঠিক ডাইরি বলা চলে  না, বরং ডাইরির ভিত্তিতে সেই সময়ের ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। আর এটা করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে হয়তো একাত্তরের আগে বা পরের সময়েও ফিরে যাবো আমরা।

একটা কথা আছে "ভয়ের (ভীতির)  চোখ গুলো বড় বড় (fear has big eyes)" যতক্ষণ কিছু না ঘটে, আমরা এক ধরণের অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকি আর এটা আমাদের ভীত করে তোলে, কিন্তু ঘটনা যখন ঘটেই যায়, আমরা সেটার মোকাবেলা করতে চেষ্টা করি, ভাবতে শুরু করি কিভাবে এটাকে এড়ানো যায়। ২৭ তারিখে যখন গ্রামের মানুষ পালাতে শুরু করে, সেটা ছিল ভয়ে আক্রান্ত হয়ে যেকোনো ভাবেই হোক এই বিপদ থেকে দূরে সরে যাওয়া।  কিন্তু গত কয়েকদিনে মানুষ প্রথম ভয়টা কাটিয়ে উঠেছিল আর ঠান্ডা মাথায় ভাবছিলো তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। এই কিছুদিন আগেও, সেই ৬৯ এর অভ্যুত্থান থেকে দুদিন আগে পর্যন্ত যে মানুষগুলো একসাথে চলেছে, একই ভাবে শেখ মুজিবের পেছনে দাঁড়িয়েছে, নতুন বাস্তবতায় দেখা গেলো সেই ঐক্য আর রইলো না।  গ্রামের হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে আগের সেই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব হঠাৎ করেই কর্পূরের মত  উবে গেলো। প্রায় প্রতিদিনই খবর আসতে  লাগলো, ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই চলে যাওয়া এখনো শেষ হয়নি।  তবে তখন মানুষ যাচ্ছিলো পাশের কোনো গ্রামে, আজ যাচ্ছে পাশের দেশে। তখনকার যাওয়া ছিল সাময়িক, আজ চিরদিনের জন্য।

এতদিন যে ব্যাপারগুলো আমাদের একটা বিশেষ অবস্থানে রেখেছিলো, আজ তাই আমাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো।  গোলা ভরা ধান. গোয়াল ভরা গরু, রমরমা ব্যবসা - এসব ছেড়ে হুট্ করে চলে যাওয়া যায় না।  তাছাড়া বাবা আর জ্যাঠামশায় কিছুতেই বাড়ি ছাড়তে রাজি হচ্ছিলো না। বাবা কখনো গ্রামের কোনো ঝামেলায় যেত না, ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো আর যখনই  কেউ সাহায্য চাইতো, সেটা করার চেষ্টা করতো।  বাবার সম্পর্কে যেটা শুনেছি, কলকাতায় বঙ্গবাসী  কলেজ শেষ করে  নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিল, পরে এক সাধুর পাল্লায় পড়ে  নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, পরে আসামে তাকে খুঁজে পায় দাদু, ওখান থেকে ফিরে  ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করে। গ্রামের কোনো সালিশি বা পূজা-পার্বনে যেতে দেখিনি তাকে, দিন কাটতো খদ্দের বা অন্যদের সাথে গল্প করে আর বই বা খবরের কাগজ পড়ে। জ্যাঠামশায় কবিরাজি করতো, মানে কারো কোথাও  কেটে ছিঁড়ে গেলে মন্ত্র পরে ভালো করে দিতো। আর করতো সেটা বিনে পয়সায়।  তাই ওদিক থেকে দেখতে গেলে তাদের কোনো শত্রু ছিল না। কিন্তু অবস্থার  যখন অবনতি   হতে লাগলে আমরাও কান্নাকাটি শুরু করলাম, সামসু চাচা, নোয়াই চাচা - এরাও বোঝাতে লাগলো - ঠিক হলো, আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো।  কিন্তু সমস্যা হলো, শুধু আমরা নিজেরাই ২০ জনের উপরে, কোথায় যাবো সবাইকে নিয়ে।

 বড়দা বৌদি, বড়মাকে নিয়ে গেলো কলতার দিকে।  বড় দার যাত্রার  দল ছিল, অনেক জায়গায় পরিচিত লোকজন ছিল, তাই  ওদিকে যাওয়া।  কলতায়  তখন যাবার একমাত্র উপায়  ছিল  পায়ে হেটে যাওয়া - বর্ষাকালে নৌকা। এখানে বলা ভালো আমাদের যাবার খুব যে বেশি জায়গা ছিল তা নয়।  আগেই বলেছি তরা  গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে বিখ্যাত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক।  সে সময় উত্তর বঙ্গ  আর খুলনা বিভাগের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের একমাত্র  রাস্তা।  আশ্চর্য  হলেও সত্য, যে রাস্তা দেশের এক প্রান্তের সাথে আরেক প্রান্তের যোগাযোগসূত্র, সেটাই  তরা  গ্রামকে দুইভাগে ভাগ করেছিল।  রাস্তার পুবদিকের অংশের সাথে আমাদের যোগাযোগ খুব কম ছিল, যেমন কম ছিল পাশের গ্রাম গিলন্ডের  সাথে যোগাযোগ। এটা মনে হয় গিলন্ডের ছেলেমেয়েরা নবগ্রাম স্কুলে যেত বলে। একই ভাবে উত্তর তরার সাথেও আমাদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।  তাই যখন বাড়ী  ছাড়ার কথা এলো, স্বাবাভিক ভাবেই ভাবতে হলো পশ্চিমে কোথাও যাবার।  এর মধ্যে ছোট কাকা খুড়ীমা, চন্দনা, চন্ডী  মামা, লক্ষ্মী মাসিকে নিয়ে চলে গেলো দৌলতপুর দাদুর ওখানে।  আমরা যারা রইলাম (আমরা পাঁচ ভাই, দিদি, বৌদি, বাবা, মা, জ্যাঠামশায়, মেঝমা, শ্যামলদা,রঞ্জিতদা) আমরা রওনা হলাম মাইল্যাগীর  পথে।

মাইল্যাগী  - এটা ঘিওরের আগে ছোট একটা গ্রাম।   কালিগঙ্গার তীরে।  আমাদের এলাকায় কালিগঙ্গা বেশ বিশাল নদী  হলেও ঘিওর এলাকায় তা ছিল খালের মত  সরু।  আমাদের একটু উজানে, কাউটিয়া এলাকায়,  যেখানে কালিগঙ্গা আর ধলেশ্বরী মিশেছে, সেখান থেকেই কালিগঙ্গা ধারণ করেছে বিধ্বংসী রূপ।  চৈত্র মাসে এসব জায়গায় তেমন জল থাকে না।  তাই বাবাকে দেখতাম বর্ষায় ঘিওর হাটে  যেত  নৌকা করে, আর এই সময় সাইকেলে।  সকাল বেলায় ঘোড়া আসতো  সুতার বস্তা নিতে।  তবুও আমার যতদূর মনে পরে, আমরা নৌকা করেই গেছিলাম মাইল্যাগি। কেননা নদীর পার দিয়ে রাস্তা ছিল না বললেই চলে, প্রায়ই ভাঙতো নদীর তীর। এইতো মাত্র কিছুদিন আগের কথা।  বাবার অনেক আগেই ঘিওর হাট  থেকে ফেরার কথা ছিল, অথচ কোনোই খবর নেই। ছোট কাকা এসে জিগ্যেস  করলো, "নয়া বৌদি, নয়া দা আসেনি এখনো?" আরো কিছু ক্ষণ  পরে জ্যাঠামশায় খোঁজ নিলো বিন্দার (বাবার নাম বৃন্দাবন, জ্যাঠামশায়  বাবাকে বিন্দা নাম ডাকতো।) বাবা কখনো রাস্তায় দেরী  করতো না, তাই লোকজন বেরিয়ে পড়লো বাবার খোঁজে।  অনেক রাতে বাবাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো।  শুনতে পেলাম বাবা সাইকেল থেকে পরে গেছিলো, আর অনেক খুঁজে নদীতে যখন বাবাকে পাওয়া গেলো, তাকে ওঠানোর কিছুক্ষন পরেই বিরাট মাটির ধ্বস নামলো সেখানে। তাই সব দিক ভেবে দেখলে মনে হয় হেটে আমরা যায়নি সেখানে, যদিও দিদি বললো হেঁটেই গেছিলাম।  তবে কিভাবে গেলাম সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা বাড়ী  ছাড়তে হলো, বিশাল পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো বিভিন্ন জায়গায়।

আমার খুব একটা বেশি কিছু মনে নেই  মাইল্যাগীর দিনগুলোর কথা।  আমরা ছিলাম মেঝমার দূর সম্পর্কের ভাই আমাদের বীরেশ্বর (যতদূর মনে পরে) মামার  বাড়িতে।  ওখানে থাকাকালীন একবার বা দুইবার বাবা বাড়ী  গেছে  খোঁজ খবর নিতে।  একবার গেলো রতনকে নিয়ে।  আমিও বায়না ধরলাম, নিলো না, তবে বললো বাড়ী  থেকে আমার জন্য ফেলে আসা মার্বেল, লাটিম, সিগারেটের খোলা এসব নিয়ে আসবে।  আমার খুব ইচ্ছে ছিল মাত্র কয়েকদিন আগে বাবা আমাকে যে সাদা রঙের চামড়ার জুতোজোড়া কিনে দিয়েছিলো তা যেন নিয়ে আসে।  তবে ওটা আর আনা  হয়নি।  তবে ওই জুতাজোড়ার কথা আমার খুব মনে আছে।

আমার ঠিক মনে নেই কতদিন আমরা ছিলাম ওই গ্রামে। তবে ওখানে থাকাকালীন খবর পেলাম আমাদের গ্রামে হিন্দুদের বাড়ী  ঘর লুট হয়ে গেছে, শামসু চাচা আর নোয়াই চাচা আমাদের বাড়ী  কিনে রেখেছে বলে লুটেরাদের  হাত  থেকে বাঁচাতে পেরেছে।  এর পর  এলো পরা কাকা (পরেশ সাহা), নিরা কাকা (নিরানন্দ সাহা), জগাই কাকা (জগদীশ সাহা), রমেশ বসাক, বলাই গোসাই আর তার বৌয়ের হত্যার খবর। এই হত্যাকান্ডগুলির সাথে জড়িত ছিল গ্রামেরই কিছু লোকজন। এর মধ্যে বলাই গোসাই আর তার বৌকে কুয়ায় ফেলে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যেই মাইল্যাগীর চেয়ারম্যান বলতে শুরু করলো আমরা যেন ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাই। কেননা তারা আমাদের ক্ষতি হোক সেটা চায়নি, তবে দেশের  ওই অবস্থায় আমাদের  রক্ষা করার মতো ক্ষমতা তাদের ছিল না।  তখন আমাদের খদ্দের বাংগালার কুদ্দুস ভাই বাবাকে বললো তাদের ওখানে যেতে।  মাইল্যাগী  থেকে আমরা পায়ে হেটে রওনা হলাম বাংগালার পথে।


দুবনা, ০৫ অক্টবর ২০১৬