২৬ তারিখ সারা দিন কাটলো গৃহহারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যায়, যখন মানুষের ঢল কমলো, রাতের সাথে সাথে বাড়িতে নেমে এলো এক ধরণের আশংকার ছায়া। অনেক রাতেও যখন বাবা ফিরে এলো না, এক অজানা ভয় পেয়ে বসলো সবাইকে। যদিও সবাই চেষ্টা করছিলো একে অন্যকে সাহস দিতে, মনে মনে সবাই ছিল দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ। অন্যদের কথা জানি না, এক সময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৭ তারিখে মানুষের ঢল অতটা বেশি ছিলো না। খবর এলো আর্মি ঢাকা থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। তখন কেন যেন সবার ধারণা ছিল পাঞ্জাবীরা সাঁতার কাটতে পারে না। তাই পাক আর্মি যাতে আমাদের দিকে আসতে না পারে সে জন্য ফেরী চলাচল বন্ধ করা হলো। গুজব ছড়িয়ে পড়লো গ্রামে, যে পালাতে হবে। আমাদের গ্রামটা বেশ বড়, প্রচুর লোকের বাস। হিন্দু-মুসলমান প্রায় ৫০-৫০। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই চলে গেছে বড় খাল, তার পশ্চিম দিকে মূলতঃ হিন্দু পাড়া। হিন্দুদের অধিকাংশই তাঁতী, তাঁতের কল ঘরে ঘরে। ওদের প্রায় সবাই আমাদের খদ্দের। আমাদের বাড়ী থেকেই তারা সুতা কিনে লুঙ্গী, গামছা আর চাঁদর বুনতো। সাহারা ছিল মূলতঃ ব্যবসায়ী। আমাদের ছিল সুতার ব্যবসা, অন্যরা মূলতঃ ধানচালের ব্যবসা করতো। কিছু কিছু ছিল পানের ব্যবসায়ী। এছাড়া ছিলি জেলে পাড়া, আমাদের বাড়ীর পাশেই - মাছ ধরা ছিলো ওদের মূল কাজ। এছাড়া চৈত্র মাসে ওই পাড়ায় হতো চৈতী পূজা - অনেক নাচ, বিশেষ করে রাতের বেলা ভুত-পেত্নীর নাচ - যা দেখতে গিয়ে ভুতের ভয়ে শিউরে উঠতাম। যদি না পাক বাহিনীর আক্রমণ, কয়েক দিন পরেই শুরু হয়ে যেত চৈত্রের ঢাক গুড়গুড়। আমাদের পাড়ায় আরো কয়েক ঘর সাহা আর বসাক বাড়ী ছিল। তারপরেই শুরু হয় মুসলমান পাড়া। ওদের অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী, অনেকেই কাজ করতো আমাদের বাড়িতে, জমিজমা দেখতো বা রঙের কারখানায় সুতা রং করতো। আমার ছোট বেলা কেটেছে বদু ভাই, সালাম ভাই, নালু ভাই - এদেরই কোলে পিঠে। ওই সময় বাড়িতে মাংস রান্না হতো না, মানে রান্না ঘরে মাংস উঠতো না। জ্যাঠামশাই জানলে সবাইকে বকতো। তাই মা বদু ভাইকে দিয়ে লুকিয়ে মুরগী কিনে আনাতো, ওরাই সব কেটে রাখালদের রান্না ঘরে রাঁধার ব্যবস্থা করতো বা বাংলো ঘরে স্টোভে রান্না হতো। আমাদের তখন একান্নবর্তী সংসার। বাবা, কাকা, জ্যাঠা সবাই একসাথে। কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন (আমাদের বাড়ীতে অনেকেই থাকতো, কেউ বাজার করার দায়িত্বে, কেউ হিসাব রাখার, আবার বাবা-কাকাদের অনেক বন্ধুদের ছেলেরা আমাদের বাড়ী থেকে কলেজে পড়তো, কেননা তখন রাস্তাঘাট ছিল না), ধান-ভাঙার লোক, বাসন মাজার লোক, রাখাল আর রঙের কর্মচারী নিয়ে মানুষ থাকতো জনা পঞ্চাশ। তিন মাস করে করে পালি পরতো মা, মেঝমা বা খুড়ীমার কাঁধে। তখন উনিই ছিলাম হেঁসেলের মালিক, সমস্ত লোকদের খাওয়ানো-পড়ানোর দায়িত্ব তার। মার্ পালি শেষ হলেই মা চলে যেত ভারতে ভাই-বোনদের কাছে, কম করে হলেও তিন মাসের জন্য আর ঘুরে বেড়াতো তীর্থ থেকে তীর্থে। আমি ৬৯ ও ৭২ তে মায়ের সাথী ছিলাম, পরে অনেক বলেও নিতে পারেনি, আমি স্কুলে গিয়ে আর পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে সময় কাটাতেই পছন্দ করতাম।
মিলিটারি আসার হুজুগ ছড়িয়ে পরলে গ্রামের হিন্দুরা পালাতে শুরু করে। এর আগেও তো বেশ কয়েকবার দাঙ্গা হয়েছে, তাই সবাই কমবেশী ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেলেছিলো। আমার জীবনে এটাই প্রথম পালানো। মার্ মুখে শুনেছি আমার জন্মের সময় দাঙ্গার সম্ভাবনা দেখা দিলে গ্রাম খালি হয়ে যায়। তাই মা আমার না রাখে বিজন। আমার জন্ম তারিখ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, ২৫ সে ডিসেম্বর, মা বলতো বড়দিন। কল্যাণদার মতে ওটা ছিল ১৯৬৩, তপনদা বলে ১৯৬৪ আর প্রাইমারী স্কুলের ছোট মাষ্টারমশাই স্কুল শেষ করার পর ওটাকে করে দিয়েছে ২ জানুয়ারী ১৯৬৪, যেটা আমার জেক বলে অফিসিয়াল জন্মদিন। তবে আমার এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই, আমি সেই যে ২৫ সে আটকে গেছি, তারপর আর বড় হতে পারছি না।
যদিও মা বাড়ি ছাড়তে চাইছিলো না, তবে শেষ পর্যন্ত নোয়াই (নবাব আলী) চাচা, সামসু চাচা এসে বলে মাকে রাজি করালো। মানুষ দৌড়ুতে শুরু করলো পশ্চিম দিকে। পথেই গ্রামের বাজার। ওখানে দেখি লোকের ভীড়, সবাই বলছে পুলিশরা নাকি আর্মির মোকাবিলা করতে পাইপ গান বসিয়েছে বাজারে। পাইপ গান ব্যাপারটা কি আজও জানা হয়নি, তবে ওটা তখন মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছিল।
গ্রাম ছেড়ে আমরা ছুটলাম জাবরা ভূঁইয়া পাড়ার দিকে, ওখানে আমাদের অনেক পরিচিত ছিল, কুসুম আপা দিদির ক্লাসমেট, আমাদের বাড়ি আসতো, আমরাও যেতাম। লক্ষ্য আপাততঃ ওটাই। দৌড়ুচ্ছি, দৌড়ুচ্ছি - ছেলে-বুড়ো পুরুষ-মহিলা - সব। পায়ের নীচের সর্ষে ফুলগুলো দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে পেছনে। জানি না কেন, মার্ সাথে যখন বাসে করে শিবরাত্রির মেলায় যেতাম, খুব পছন্দ করতাম বাসের সিঁড়িতে বসে দূর্বা গুলা কিভাবে পেছন দিকে দৌড়ুচ্ছে তা দেখতে। পরে যখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ওই ঘটনা দিয়ে বুঝাতাম, যারা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, তারা ওই ঘাসগুলোর মতোই জীবনের দৌড়ে পেছনে পরে যায়। কে জানে হয়তো ওই দিন থেকেই সর্ষে ক্ষেত্ আমার এত প্রিয়, এতো ভালোবাসি সর্ষে ক্ষেতের ছবি তুলতে।
ভূঁইয়া পাড়ায় গিয়ে শেষ হলো আমাদের দৌড়। ওরা আমাদের শান্তনা দিলো। দুপুরের পরপর ডাক এলো বাড়ি ফিরে যেতে। মনে নেই ঐদিন বিকেলে নাকি পরের দিন সকালে বাবা ফিরে এলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা। এসেই শুয়ে পড়লো বারান্দায় বিছিয়ে দেয়া শীতল পাটির উপর। আমরা পায়ের কাছে বসে পা টিপে দিতে লাগলাম। বাবা হাত থেকে এলেও আমরা পা টিপে দিতাম, তখন, তার পরেও। এখন এই স্মৃতি লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে বাবাকে কোনো দিনই জিজ্ঞেস করা হয়নি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ী ফেরার কাহিনী। আরো কত কথাই যে জিজ্ঞেস করা হয়নি! রাতটা আমরা বাড়িতেই কাটালাম। ঢাকা থেকে ক্রমাগত ভয়াবহ খবর আসতে শুরু করলো। তাই ঠিক করা হলো পরে দিনই বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হবে দূরের কোনো গাঁয়, যেখানে পাক বাহিনী সহজে আসতে পারবে না।
মস্কো, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
Friday, September 23, 2016
Tuesday, September 13, 2016
২. মানুষের ঢল
মানুষ আর মানুষ। ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা - মানুষের ঢল। একের পর এক আসছে -
আবার বানের জলের মতো চলে যাচ্ছে আমাদের পেছনে ফেলে। এর মধ্যেই আমরা কাউকে দিচ্ছি জল, কাউকে দুধ - সারা গ্রাম যেন এক বিশাল শরণার্থী শিবির - যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে ঢাকা থেকে আসা মানুষগুলোকে। সকালে খবর এসেছে ঢাকার উপর হামলা করেছে পাক হায়েনার দল। দুপুর না গড়াতেই আমরা হচ্ছি তার চাক্ষুষ সাক্ষী। আমার এই ছোট্ট জীবনে এতো মানুষ দেখিনি কখনো। এমন কি রথের মেলায়ও নয়। এইতো মাত্র বছর দেড়েক আগে কলকাতা থেকে ঘুরে এলাম। সেখানেও লোকে লোকারণ্য। কিন্তু এতো মানুষ? সবাই পালাচ্ছে - সবার লক্ষ্য এক - ঢাকা থেকে যত দূরে পালানো যায়। ফেরি তো আছেই, এর পরেও গ্রামের লোক যে যেভাবে পারছে, নৌকা দিয়ে পার হতে সাহায্য করছে ঢাকার শহুরে মানুষগুলোকে। বলতে গেলে সবাই খালি হাতে, এক কাপড়ে বেরিয়ে আসা মানুষ। কারো বা কোলে বাচ্চা। আমার নিজের বয়স ছিল তখন সাত, তার পরেও যেন হঠাৎই বড় হয়ে গেছিলাম, আমাদের মতো ছেলেমেয়েরা মিলে বড়রা যে খাবার বা দুধ দিতো, তাই দিয়ে আসতাম পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর হাতে।
কালিগঙ্গা নদীর উপরে কালিগঙ্গা সড়ক সেতু, যা তরা ব্রীজ নামেই পরিচিত, তখনও হয় নি। ভ্যানেল কোম্পানি সবে কাজ শুরু করেছে। সে সময় এমন কি চৈত্র মাসেও নদী যথেষ্ট গভীর আর স্রোতস্বিনী। তাছাড়া ব্রীজের কাজ শুরু হওয়ায় ফেরিঘাট আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই। তাই লোকজনের ঢল যাচ্ছিলো আমাদের রংখোলার উপর দিয়ে। রংখোলা এটা আমাদের পুরানো বাড়ি। আমার জন্মের আগেই নদী ভাঙার কারণে আমরা একটু ভেতরে চলে এসেছিলাম। এখন নদী অবশ্য বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে চলে গেছিলো। রংখোলা নাম হয় এ কারণে যে, এখানে নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা আর রং এনে রং করা হতো আর পরে ওটা তাঁতীদের কাছে বিক্রি করা হতো। ওটা ছিল আমাদের মূল ব্যবসা। সপ্তাহে দু' বার করে বাবা বা কাকা নারায়ণগঞ্জ যেত সুতা আনতে, ফিরতো ৫ টনি ট্রাক ভর্তি রং আর সুতা নিয়ে। গ্রামে তখন গাড়ি আসা বলতে এটাই বুঝাতো যদিও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে গাড়ি চলতো অনবরত। ট্রাক থেকে মাল নামানো শেষ হলে আমরা বাচ্চারা ওই ট্রাকে চেপে যেতাম ফেরী ঘাট পর্যন্ত। সোমবার আর বৃহস্পতি বার ছিল নারায়ণগঞ্জ যাবার দিন, যাতে বুধবার আর শনিবার যথাক্রমে ঘিওর হাট ও ঝিটকা হাটে খদ্দেরদের কাছে রঙিন সুতা পৌঁছে দেয়া যায়। ২৫ মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার, বাবা গেছেন মোকামে মানে নারায়ণগঞ্জ মাল আনতে। যদিও অনেক দিন ধরেই বাড়ীর সব থেকে লম্বা আমগাছের মাথায় আরো লম্বা এক বাঁশের মাথায় কালো পতাকা উড়ছিলো পতপত করে, গ্রামের বাজার মাঝে মধ্যেই এর মূল জায়গা থেকে রমন সাধুর আখড়ার ওখানে খালে বসছিলো, তবুও পঁচিশে মার্চের কালো রাত যেন হঠাৎ করেই এসেছিলো। অন্ততঃ আমার বাড়িতে যুদ্ধ নিয়ে কোনো আলোচনার কথা মনে পড়ে না। আর ১৯৬৯ সালে ইন্ডিয়া যাওয়া থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ঘটনাই আমার খুব ভালো ভাবে মনে আছে। তাই বাবা নারায়ণগঞ্জ আটক পড়ায় সবাই চিন্তিত ছিল, তবে বাবা যে ফিরে আসবে এ নিয়ে কারো সন্দেহ ছিল বলে মনে হয় না। প্রশ্নটা ছিল কবে আর কিভাবে। কেননা অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে ২৭ মার্চ থেকেই, বাড়ী থেকে যে পালাতে হবে এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে।
দুবনা, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
Subscribe to:
Posts (Atom)