আজকাল প্রায়ই দেখি নতুন বই হাতে স্কুলের বাচ্চাদের হাসি মুখ। তখন মনে পরে যায় যুদ্ধের পরের দিনগুলির কথা। আমাদেরও তখন এমনি করেই নতুন বই দেয়া হয়েছিল। সাথে ছিল নতুন খাতা, রঙিন পেন্সিল, প্লাস্টিক কালার। সব নতুন আর বিদেশী। আর ছিল স্কেল, পেন্সিল কাটার মেশিন। জানি না শহরে কেমন, কিন্তু গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে এসব ছিল ভিনগ্রহের উপহারের মত। এখনও মনে আছে “সেভ দ্য চিলড্রেন” এর লোগো আঁকা সেইসব খাতার কথা। তখন আমার আঁকার প্রিয় বিষয় ছিল ছোট নদী, নদীর এপারে ঘাসফুল, অন্য
পারে দোচালা ঘর আর নদীতে বয়ে যাওয়া পালতোলা নৌকা। কখনো কখনো আকাশে উড়ত ফাইটার বিমান।
তবে শুধু যে স্কুলেই সাহায্য আসছিলো তা কিন্তু নয়। ঐ সময়ই চালু হয় রেশন কার্ডের। তখন আমাদের কোন পরিচয়পত্র ছিল না, না জন্ম নিবন্ধন না ভোটার কার্ড। রেশন কার্ডই ছিল একমাত্র লিগ্যাল ডকুমেন্ট। ঐ কার্ড দেখেই গম দিতো, কম্বল দিতো। কখনো-বা চাল। এই গম আর কম্বলের হাত ধরে দেশে এলো গম চোর আর কম্বল চোররা। এল কালো বাজারী। আগের টাউট-বাটপার আর ফোর টুয়েন্টির সাথে এলো স্মাগলার আর লোফার। রাশিয়ানরা বলে দুঃখ একা আসে না। আমার তো মনে হয় সুখও একা আসে না। জীবন যাতে পানসে না হয়ে যায় ভালো সব সময় কিছু মন্দকে সাথে করে নিয়ে আসে। যেখানে মধু সেখানে যেমন মৌমাছির আনাগোনা, যেখানে ক্ষমতা সেখানে তেমনিই ক্ষমতালোভীর আনাগোনা। আর এতে করে যত দুর্ভোগ জোটে সাধারণ মানুষের কপালে। কবির কথাকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়
অধম নিশ্চিতে চলে উত্তমের সাথে
বাঁশ খায় তারা, যারা চলে তফাতে।
যতই দিন যাচ্ছিল, গ্রামের লোকেরা একের পর এক ফিরে আসছিলো। শুধু যে একাত্তরে দেশত্যাগী মানুষই ফিরছিল, তাই নয়। ছিল যুদ্ধের আগে চলে যাওয়া লোকজনও। দ্বিজাতি তত্ত্ব পরিত্যাগ আর ভারতের সাথে বন্ধুত্ব তাদের মনে আশা জাগিয়েছিল, তারা ভেবেছিল সাম্প্রদায়িকতা এ দেশ থেকে চিরতরে দূর হয়েছে। এখন আর হিন্দু বলে কেউ তাদের দিকে কটাক্ষ করবে না, কথায় কথায় তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলবে না। তাই অনেকেই ভাবছিল আবার ফিরে আসার কথা, নিজের জন্মভুমিতে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা।
আমি বেশ কয়েকবার ভারতে গেছি আর প্রতিবারই যখন পশ্চিম বাংলায় কেউ জেনেছে আমি বাংলাদেশ থেকে, সব কাজ ফেলে বসেছে গল্পের ঝুরি মেলে। গল্পে গল্পে ফিরে গেছে নিজেদের ফেলে আসা বাড়িতে। আর যশোর বা কুমিল্লা বা চট্টগ্রাম যে মানিকগঞ্জ থেকে অনেক দূরে আর আমি জীবনে কখনো তাদের ওই এলাকায় যাই নি, এটা তাদের এই গল্প বলায়, দেশের জন্য নস্টালজিক হতে মোটেই বাধা দেয় নি। শুধু তাই কেন, অনেকের সাথে দেখা হয়েছে যাদের জন্ম ভারতে, কিন্তু বাবা-মা বা ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনতে শুনতে তারা বাংলাদেশে ফেলে আসা সেই বাড়িঘরকে, সেই প্রকৃতিকে এমনভাবে ভালবেসেছে যে আমাদের কাছে পেলে তারা যেন হাতে চাঁদ পায়, দুদণ্ড কথা বলে আমাদের চোখ দিয়ে হলেও নিজের দেশটাকে দেখতে পায়। আমি তাদের বুঝি। এরা পুরুষের পর পুরুষ বাংলার মাটি, বাংলার জলে, বাংলার ফুল, বাংলার ফলে বড় হয়েছে – তাই এ দেশের প্রতি টান থাকাটাই স্বাভাবিক। একই সাথে আমার বুঝতে কষ্ট হয় অন্য একটা জিনিষ। উত্তর ভারতের মুসলিম অভিজাত শ্রেনীতে পাকিস্তানের ধারনা অনেক আগে থেকে থাকলেও জোরেশোরে তার দাবী ওঠে ১৯৪০ সালে। এর ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ – পাকিস্তানের জন্ম আর তারপর পাকিস্তানের বাংলা ও বাঙ্গালী বিরোধী নীতিতে বীতশ্রদ্ধ বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রাম আর শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে বাংলাদেশের আবির্ভাব। যদি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত উত্তর ভারতের আর বাংলার মুসলিম নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রেমের হয়, সেই ১৯৪৭ সালেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলার মধ্য দিয়ে এ প্রেমের শেষ – এরপর বাহান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর আর সব শেষে একাত্তর। তার অর্থ দাঁড়ায় সাত বছরের প্রেম, বিয়ে, তার পরের চব্বিশ বছর নিরন্তর ঝগড়াঝাঁটি আর শেষে রক্তাক্ত বিচ্ছেদ। তা সে একত্রিশই হোক আর চব্বিশই হোক, যে সময়ে বড়জোর দুটো প্রজন্ম গড়ে উঠতে পারে, এটা খুবই কম সময় যখন কিনা বাংলাদেশের লোকজনদের মধ্যে পাকিস্তান সম্পর্কে কোন রকম নস্টালজিয়া তৈরি হতে পারে। তাই যখন আজ বাংলাদেশে কারনে অকারনে অনেকের মধ্যে পাকিস্তান প্রেমের বন্যা দেখি – কোন সুস্থ লজিক দিয়ে সেটা বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে পারি না।
যা হোক, ফিরে আসি আসি আবার বাহাত্তরে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা দেখে পাকিস্তান আমলে চলে যাওয়া অনেকেই আশায় বুক বাধে, সিরিয়াসলি ভাবতে থাকে দেশেই আবার কিছু করার কথা। কিন্তু শত্রু সম্পত্তি আইন তুলতে সরকারের গড়িমসি সে আশার গুড়ে বালি দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করব আবার সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয় এমন কালা কানুন চালু রাখব – এটা হয় না। শত্রু সম্পত্তি আইন - এটা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বসানো টাইম বোমার মত যা আজ হোক কাল হোক ফুটতে বাধ্য। সরকার সেটা বুঝতে না পারলেও সাধারন মানুষ, সংখ্যালঘুরা সেটা ঠিকই বুঝেছিলো, আর তাই পাকিস্তান আমলে যারা দেশত্যাগ করেছিলো, তারা তো বটেই, এমন কি একাত্তরে যারা গৃহহারা হয়েছিল তাদের অনেকেই দেশ ত্যাগ করতে শুরু করে। তাদের যুক্তিটা ছিল এই – বাংলাদেশে হোক আর ভারতে হোক – জীবনটা একেবারে নতুন করে, একেবারে গোড়ার থেকেই শুরু করতে হবে। তাই যেখানে তাত্ত্বিকভাবে হলেও অধিকারটা অন্তত সমান হবে – নিজেদের হাজারো কষ্ট হলেও অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সেটাই করা উচিৎ। আর তাই পাকিস্তান আমলে যেমন স্বাধীনতার পরেও ঠিক তেমনি করে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারই দেশ ছেড়ে চলে গেল। এখনও যাচ্ছে। আমাদের গ্রামও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরলেন। সারা দেশে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা। এর পরে এলো অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান। ট্রাকের পর ট্রাক মুক্তিসেনা চললো ঢাকার পথে। ফাঁকা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো দেশ। মনে আছে, তখন সড়কে যেতে ভয়ই লাগত। আমরা রংখোলায় দাঁড়িয়ে দেখতাম ওই ট্রাকগুলোর চলে যাওয়া আর শুনতাম গুলির শব্দ। রাশিয়ানরা বলে, “সব যুদ্ধই শেষ হয় শান্তি চুক্তির মাধ্যমে।“ বাংলাদেশেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। কিন্তু চুক্তি হলেই যে শান্তি আসবে তার গ্যারান্টি কোথায়? একাত্তর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু সব জায়গায় শান্তি এসেছে কি? বিশেষ করে যে সব দেশে স্বাধীনতা এসেছে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে? যুদ্ধের পর প্রচুর অস্ত্র থেকে যায় মানুষের হাতে আর এরাই পরবর্তীতে বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত হয়। এখনও মনে আছে রাতের পর রাত পাড়া-প্রতিবেশিদের বাড়িতে ঘুমানোর কথা। এমন কি একাত্তরেও আমাদের এমন ভয়ে কাটাতে হয় নি যেমনটা একাত্তর পরবর্তী দিনগুলোতে। সন্ধ্যা হলেই গ্রামের লোকেরা পাহারা দিতে চলে যেতো আর শোনা যেতো সেই পরিচিত ডাক
জাগোরে বস্তিওয়ালারা
হৈ... হৈ...
মনে আছে কোথাও কারো পায়ের শব্দ পেলেই জিজ্ঞেস করতাম
- কে যায়?
- আমি।
- আমি কে?
সন্ধ্যার পর নেমে আসতো পিন পতন নিস্তব্ধতা। কোন শব্দ শুনলেই বুঝার চেষ্টা করতাম গুলির শব্দ কিনা আর কোন দিক থেকে আসছে। এখনও মনে মনে এক দিনের কথা, যদিও সেটা ঘটেছে অনেক পরে – চুয়াত্তর বা পঁচাত্তরের দিকে। ওই সময় দেশে আকাল চলছে। কাজকর্ম নেই – ক্ষুধা আর ক্ষুধা মানুষকে অজগর সাপের মত পিষছে দিনের পর দিন। তখন প্রায়ই উত্তর বঙ্গ থেকে লোকেরা আসতো কাজের খোঁজে। আর যেহেতু আমাদের বাড়ি ছিল এলাকায় খুব পরিচিত, তাই অনেকে সোজা আসতো আমাদের বাড়িতে। তখন আমাদের ট্র্যাডিশনাল সুতা রংএর কাজ ছাড়াও ছিল মানিকগঞ্জে কাপড়ের দোকান, কেরোসিন তেলের ব্যবসা। জমিজমা তো ছিলই। তাই অনেকের ধারনা ছিল আমাদের কাছে এলে কিছু একটা ব্যাবস্থা হবেই। তা ওই দিন সন্ধ্যার পর এলো জনা দশেকের এক দল, বলল উত্তর বঙ্গ থেকে এসেছে কাজের খোঁজে। ঠিক তার দু দিন আগেই এক দল কামলা নিয়েছে বাড়িতে, তাই বাবা বলল, কাজ তো নেই, তবে রাতে আমাদের বাড়িতে থেকে পরের দিন কোথাও যেতে কাজের খোঁজে। জ্যাঠামশাই কিছুতেই রাজী না অপরিচিত এতগুলো লোককে বাড়িতে থাকতে দিতে। আমরা চেষ্টা করলাম জ্যাঠামশাইকে বুঝাতে, কিন্তু কোনই ফল হোল না। কি আর করা। বাবা হযরত ভাইকে বললো ওই লোকগুলোকে সড়কের পাশে সিএনবির জায়গায় দিয়ে আসতে আর সাথে দিল কিছু চালডাল যাতে রান্না করে খেতে পারে। কিন্তু ওখানে গিয়েই লোকগুলো হযরত ভাইএর সাথে খারাপ ব্যবহার করে আর চালডাল নিতে অস্বীকার করে। হযরত ভাই বাড়ি ফেরার পথে ব্রীজের গোরায় পাহারারত পুলিশদের ওদের কথা বলে ফিরে আসে। কিছুক্ষন পরে ওদিক থেকে হৈচৈ এর শব্দ পেলাম। পরে জানা গেল
দু’জন পুলিশ ওই লোকদের ওখানে গেলে ওরা ভয়ে কি একটা পোটলা ছুঁড়ে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশের ডাকে আশেপাশের লোকজন এসে ওদের ধরে ফেলে। ওই পোটলায় ছিল একটা স্টেন গান আর ছিল গ্রামের হিন্দু মুসলমান সব মিলে জনা পঞ্চাশের এক লিস্ট, যাদের ওরা ওই রাতে হত্যা করতে চেয়েছিলো। ওই লিস্টের প্রথম দিকে বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাইদের নামও ছিল। ওরা আগে থেকেই গ্রামের অন্য দিকে কিছু অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলো। এরকম ঘটনা তখন অনেক ঘটেছে। ঐ সময়
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল রক্ষী বাহিনী। গ্রামের লোকেরা বলতো লক্ষ্মী বাহিনী। কে জানে লক্ষ্মী এটা ভালোর প্রতিশব্দ
হিসেবে নাকি ভারতের সাথে বন্ধুত্বের কারণে মা লক্ষ্মী থেকে এ নাম। তবে যাই হোক, এই
বাহিনী না ছিল লক্ষ্মী, না ছিল রক্ষী। আরও ছিল লাল বাহিনী। রাশিয়ার রেড আর্মি বা
চীনের লাল ফৌজের অনুকরনে। তবে এরা মোটেই সৈন্য ছিল না। আমাদের তরা ঘাটের কুলিরা
লাল পোশাক পরতো আর নিজেদের লাল বাহিনী নামে পরিচয় দিতো। সাধারণ যাত্রীদের হাত থেকে
মালামাল নিয়ে মাথায় করে চর পার করে দেয়ার জন্য তাদের প্রচেষ্টা ছিল ইন্ডিয়ায়
তীর্থক্ষেত্রে পাণ্ডাদের মতই। যুদ্ধ শেষ হয়েছিল বটে, তবে শান্তি আসেনি – শান্তি ছিল না, তাই বিজয়ের পর অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলেও অনেকেই এই নিরন্তর ত্রাসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে শুরু হয় নতুন করে দেশ ত্যাগের হিরিক যেটা এখনও চলছে পুরাদমে।
ঐ সময় বিদেশ বলতে গ্রাম বাংলায় ভারতকেই বোঝানো হতো। মনে আছে তখন শুধুমাত্র ভারত যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসপোর্ট ছিলো, পাকিস্তান আমলেও ছিলো। ঐ সময় মুসলিম বন্ধুদের বলতে শুনেছি “দেশে কিছু হলে তোদের তো ভারত আছে, আমরা যাবো কোথায়?” এখন অবশ্য পৃথিবীটা ছোট হয়ে
এসেছে, এখন ভারত গরীবের অপশন, একটু টাকার জোর থাকলে মানুষ ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকা,
ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ যায়। যায় সবাই – কি হিন্দু, কি মুসলমান - সবাই। কিছুদিন
আগে দেশে গিয়ে অজয়দার সাথে দেখা হল। উনি ঘিওর কলেজে অধ্যাপনা করেন। কথা হচ্ছিলো
আমাদের এক পরিচিত লোককে নিয়ে যিনি এক সময় এখানে অধ্যাপনা করতেন, পরে কিছুদিন
জার্মানি কাটিয়ে এখন কোলকাতায় আছেন। অজয়দা বললেন,
- ও যদি এখন দেশে থাকতো, কত ভালো করতে পারতো।
- কে জানে? জীবন
তো এক বারই সুযোগ দেয়। আমরা বারবার সেই তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাড়াই। ডাইনে গেলে
বাঘে খাবে, বায়ে গেলে ভাল্লুকে আর সামনে গেলে সাপে। পেছনে ফেরার উপায় নেই। আমাদের
সিদ্ধান্ত নিতে হয় আর যে সিদ্ধান্তই নেই না কেন, ভুল হোক শুদ্ধ হোক, সেটাইকেই বাস্তবায়ন করতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য,
আমরা একই সাথে একাধিক জীবন যাপন করতে পারি না। একটাকেই বেছে নিতে হয়।
- তারপরেও, ওরা কিন্তু গিয়েছিল বেটার ভবিষ্যতের আশায়। এখানে থাকলে ও নিশ্চয়ই আরও ভালো থাকতো, ভালো করতো।
- হয়তো বা। কিন্তু এই যে আপনারা যারা আছেন, যারা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা করেন, যারা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশটা যাতে সবার জন্য সমান হয়ে ওঠে সেটা চান, আপনারা কি আপনাদের ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চিন্ত? আমার বেশ কিছু বন্ধু অ্যামেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, কেউ কেউ থাকে ইউরোপে, কেউ-বা আমার মত রাশিয়ায়। সবাই প্রগতিশীল। দেশে থাকতে আপনাদের মতই ভাবত, অনেকে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে একসাথে কাজও করেছে। যারা এখনো দেশের কথা ভাবে, নিজেদের জায়গায় থেকে যেটুকু সম্ভব দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য করে, তারা কিন্তু বলে “হ্যা, আমরা অনেক কষ্ট করে এখানে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। অনেক সময় অনেক অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এক জেনারেশনকে তো সেটা করতেই হবে। এখন আমরা জানি আমাদের সন্তানেরা এমন একটা দেশে থাকবে যেখানে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করবে না।” মানুষ তো সহজে দেশ ছাড়ে না। মানুষ যখন জলে পরে তখন তার আশা থাকে যদি একটা খড়কুটাও পাওয়া যায়, তাকে আঁকড়ে ধরে এক সময় না এক সময় কূল পাওয়া যাবেই। কিন্তু এখন তো মনে হয় আমরা চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি। পেছনে যাবার রাস্তা নেই, সামনে পথ দুর্গম। আর সব চেয়ে বড় কথা অন্ধকার আমাদের দু পা ধরে অনবরত টানছে নিচে। আমরা দিন দিন তলিয়ে যাচ্ছি মধ্যযুগের বর্বরতায়। সত্যি বলতে কি, আমরা প্রতিদিনই একাত্তর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, দূরে সরে যাচ্ছি একাত্তরের চেতনা থেকে। আর তাইতো মানুষ, যারা একদিন বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাস করেছিল, তার ডাকে যুদ্ধে নেমেছিল – আজ তার সোনার বাংলায় থাকতে ভয় পাচ্ছে।
যাকগে আবার ফিরে আসি বিজয়ের পরের দিনগুলোয়। বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন দ্বিধাদ্বন্দ্বে সুখে দুঃখে,
আনন্দে বেদনায়, ভয়ে সাহসে কাটছিলো আমাদের যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলো। এই সময় একে একে
অনেক আত্মীয় স্বজন ইন্ডিয়া থেকে দেশে বেড়াতে এলো। এলো সন্ধ্যাদি আর লক্ষ্মী জামাইবাবু
তাপস আর সঞ্জয়কে নিয়ে। আরতিদি আর বিমল জামাইবাবু এলো রিংকু আর শম্পাকে নিয়ে। এলো
পাচু দা, ভাগুদা এলো জ্যোৎস্না বৌদি আর মিঠুকে নিয়ে দেশের বাড়িতে মিঠুর অন্নপ্রাশন
দিতে। আমাদের বাড়িতে ওটাই আমার দেখা প্রথম অন্নপ্রাশন। আমার পর বাড়িতে আর কেউ
জন্মেনি। কত লোক যে সেদিন খেয়েছিল আমাদের বাড়িতে! ওদের সাথেই এলো শ্যামলদা,
রঞ্জিতদা, দিদি, কল্যানদা – মানে আমাদের বাড়ি থেকে যারা যুদ্ধের সময় কোলকাতা
গিয়েছিলো। কিভাবে যে কেটে গেল কয়েক
সপ্তাহ। এর মধ্যে মার রান্নার পালিও শেষ হয়ে এলো। ১৯৬৯ এর পরে মার আর ইন্ডিয়া
যাওয়া হয়নি ভাইদের আর বোনের সাথে দেখা করতে। অবশেষে ১৯৭২ এর বর্ষার শেষে বিমল
জামাইবাবুর সাথে আমাকে আর রতনকে নিয়ে মা রওনা হোল কলকাতার দিকে। আমারা সাধারণত যশোরের বেনাপোল বর্ডার দিয়ে যেতাম। কিন্তু
যুদ্ধের কারণে তখনও এই বর্ডার কাজ শুরু করে নি। আমরা গেলাম গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে
করে দর্শনা বর্ডারে। দর্শনা বর্ডারেই শেষ বারের মত আমাদের দেখা হয় সন্তোষদার সাথে,
জার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল বাঙ্গালায়। ওখান থেকে রানাঘাট হয়ে আমরা চলে গেলাম কোলকাতা।
মস্কো – দুবনা, ৪ – ৭ মার্চ ২০১৭
No comments:
Post a Comment