Sunday, March 12, 2017

৪২ ফিরে এলাম বৈলতলা

মানুষের স্মৃতি অনেকটা পুরানো বইয়ের মত। বই যেমন দীর্ঘদিন অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকলে তার উপর ধূলা পড়ে, ঠিক তেমনি দীর্ঘদিন চারণ না করা স্মৃতিও ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ হয়ে যায় এই অবহেলার কাল যতই দীর্ঘ হয়, বইয়ে ধূলার স্তরের পুরুত্বও ততই বেশি হয়, ঠিক যেমনটি সময়ের সাথে বাড়ে স্মৃতির অস্পষ্টতা আবার একটু ফু দিলেই বইয়ের পাতা থেকে সেই ধূলা উড়ে গিয়ে অক্ষরগুলো যেমন স্পষ্ট হয়ে উঠে ঠিক তেমনি করেই যখনি আমরা সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করি একের পর এক স্মৃতিগুলো বেরিয়ে আসে মনের সিন্দুক থেকে পুরানো দিনের চলচ্চিত্রের মত ফিরে আসে ভুলে যাওয়া মুখগুলো, ফিরে আসে সেই মাঠ, ঘাট, নদী, এমনকি চেষ্টা করলে সেই বাতাসের স্পর্শ, সেই সময়ের গন্ধও পাওয়া যায়।

আমি যখন গত ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আমার একাত্তরের কথা লিখতে শুরু করি, আমার সম্বল ছিল কেবলমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেই হলুদ রঙা সর্ষে ক্ষেতে দৌড়ে পালানোর দৃশ্য, মাইল্যাগী গিয়ে বাড়িতে ফেলে যাওয়া মার্বেলের জন্য বায়না, বাঙ্গালার কামাক্ষ্যার হেড়ে গলায় গান, রাম মামা, কুদ্দুস ভাই, তাল গাছে বাবুই পাখীর বাসা, বৈলতলার দেবদারু, কুম, ডুঙ্গা নৌকা তৈরিতে সাট ধরা, তিল্লী বেড়াতে যাওয়া, বাড়িতে রাজাকার আসা, প্যারাস্যুটে করে সৈন্য নামা এই সব আর কি। তবে সেগুলো ছিলো বিভিন্ন সময়ে ঘটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কখনো একে অন্যের সাথে জড়িত, কখন-বা একেবারেই যোগসুত্রহীন – শুধুই যুদ্ধকালের অদৃশ্য সুতা দিয়ে গাঁথা। তবে লেখা যতই এগিয়েছে, একের পর এক ঘটনাগুলো মনের দুয়ারে হাজির হয়েছে। ইঁদারার জলে তাকালে যেমন নিজেদের মুখগুলো ভেসে উঠে, ঠিক তেমনি এক এক করে ভেসে উঠেছে হারিয়ে যাওয়া মুখগুলি। কখনো মনে পড়েছে ভুলে যাওয়া কোন নাম। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাম আর মুখ এসেছে হাতে হাত ধরে, তবে এমনও ঘটেছে যে নাম মনে পড়ছে, কিন্তু মুখটা মনে করতে পারছি না কিছুতেই, আবার উল্টোটাও ঘটেছে – নামহীন মুখ দিনের পর দিন ভেসে বেড়িয়েছে চোখের সামনে। লেখাগুলো ব্লগ হিসেবে প্রকাশ করায় ভাই-বোনেরা এগিয়ে এসেছে ওদের স্মৃতির ঝাঁপি নিয়ে, এগিয়ে এসেছে গ্রামের পরিচিত লোকজন। আর তার পরিণতি একাত্তরের এই স্মৃতিকথা।

এই লেখা শুরুর আগে পর্যন্ত কখনো আবার বাঙ্গালা বা বৈলতলা যাবার তাগিদ বোধ করিনি। মনে আছে, যুদ্ধের পরেও অনেক দিন পর্যন্ত মাখন কাকা ছানা-হারুদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু তখন পুরানো বন্ধুদের পেয়ে আমি ওদেরকে সময় দেবার তেমন দায়িত্ব বা কর্তব্য অনুভব করিনি। তারপর আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভিন্ন হয়ে যায়, একটার জায়গায় তৈরি হয় তিন তিনটে হেঁশেল। ধীরে ধীরে ওদের যাতায়াতও কমে আসে আমাদের বাড়িতে। তারপর এক সময় একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আমার ঠিক মনে নেই আমার স্কুলের শেষের দিকে বা কলেজে পড়াকালীন ওরা এসেছে কিনা আমাদের বাড়িতে। এলেও আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর এসব নিয়ে। তবে সত্যিই কি ভুলে গিয়েছিলাম ওদের কথা, বৈলতলার কথা? না। কেননা ১৯৮২ সালে তরায় যখন প্রথম খেলাঘর আসর করি, ওর নাম রাখি “হিজল খেলাঘর আসর”। আমার দেয়া নাম। আর হিজলের কথা আমার মনে এসেছিল বৈলতলার ঐ দিনগুলি থেকেই। তারপরেও কেমন করে যেন অনেক দিন ছানা-হারুদের কথা ভুলে ছিলাম, বৈলতলার কথা ভুলে ছিলাম। তাই লেখার এক পর্যায়ে যখন এসব ঘটনা মনে হোল, স্পষ্ট ভাবে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো বাঙ্গালা আর বৈলতলার দিনগুলোর কথা – তখনই ঠিক করলাম, আবার যখন দেশে যাবো, এই দু’টো জায়গায় অবশ্য অবশ্যই যাবো। আর তখনই বাড়িতে ফোন করে জানালাম ইচ্ছার কথা। ওরা বললো, এখন রাস্তাঘাট হয়ে গেছে, কোন অসুবিধা নেই। অনেক কিছুর সাথে এটাও আমাকে দেশে যেতে অনুপ্রাণিত করলো। গত বছরের মানে ২০১৬ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে দেশে গেলাম এক মাসের জন্য।

দেশে গিয়েই ঠিক করলাম অন্য কোন ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়ার আগেই ওদিকটায়  যেতে হবে। ৫ ই ডিসেম্বর রওনা হলাম বাঙ্গালা আর বৈলতলায় পথে। বাঙ্গালার সেই দিনের কথা আগেই বলেছি। এবার সময় এসেছে বৈলতলার কথা বলার। 

সেই একাত্তরের মতই এবারো আমরা বাঙ্গালা থেকে বৈলতলা গেলাম। তবে যে পথটি আমার মনের মধ্যে গাঁথা ছিল সে পথে নয়। একাত্তরে, শুধু একাত্তরে কেন, মাত্র কয়েক বছর আগেও দেশে রাস্তাঘাটের বালাই ছিল না। অনেক জায়গায় যেতে হত বর্ষাকালে নৌকা করে আর গরমে ক্ষেতের আল ধরে পায়ে হেঁটে। এখন অবস্থা পাল্টেছে। এমন কি অজ পাড়াগাঁয়েও চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা। সব জায়গায় বাস চলাচল না করলেও মিনি আর ম্যাক্সি চলছে সর্বত্রই। অনেক নতুন বাড়িঘর তৈরি হওয়ার ফলে পুরা ল্যান্ডস্কেপ বদলে গিয়েছে এলাকার। তাছাড়া সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই, মানে এখন আর চাইলেই জমির আল ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতে পারি না। তাই ভাবলাম, যতদুর সম্ভব রিক্সা বা ভ্যানে করে যাবো। যেখান থেকে রিক্সায় ওঠার কথা তার আগেই ভ্যান পেয়ে গেলাম। এটা অবশ্য ১৯৮৩ সালে আমার দেখা ভ্যান নয় যাতে করে ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা মিলে “আমরা করবো জয়” গাইতে গাইতে চলে জেতাম। এটা অনেক ভদ্র গোছের, আগে যেমনটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল, মাঝখানে পা রাখার নিচু জায়গা, আর দু’পাশে উঁচু বসার সীট। এতে সুবিধা দুটো। প্রথমত হাঁটতে হচ্ছে না, বারবার রাস্তা জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে না আবার ভ্যান চালকের সাথে গল্প করতে করতে এলাকার খবরাখবরও টুকটাক পাওয়া যাচ্ছে। এদিক থেকে দেশের, বিশেষ করে গ্রামের লোকেরা অনেক দিলখোলা, প্রয়োজনীয় - অপ্রয়োজনীয় প্রচুর খবর পাওয়া যায় ওদের কাছ থেকে। ও আমাদের নামিয়ে দিল সিংজুরী বাজারে আর বলে দিলো কিভাবে ওখান থেকে বৈলতলা যেতে হবে। আমার মনে পরে না যে সিংজুরী গ্রামে তখন এতো বাড়ি ছিল। বাজারের রাস্তার এক পাশে  স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদের অফিস, আর অন্য দিকে খাঁদ, খাঁদের পর বইরাগীর চক। কিছু দূর গিয়ে যখন ছোট রাস্তায় নামলাম – এখানে রাস্তার দু’পাশেই শুরু হোল বাড়ি – অধিকাংশই নতুন, অন্তত ঘরগুলো নতুন। হিন্দু আর মুসলমান বাড়িগুলো পাশাপাশি – বাড়ির সামনে কবর বা তুলসী গাছ, কখনো বা মন্দির দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না বাড়ির মালিকের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে। এটা অবশ্য আমাদের গ্রামেও দেখেছি। আমাদের ছোট বেলায় হিন্দু আর মুসলমান পাড়া ছিল প্রায় আলাদা, তবে এখন মালিকানা বদলের ফলে পাড়াগুল তাদের স্বকীয়তা হারিয়েছে – এদিক থেকে গ্রামগুলো অনেকটা শহুরে চরিত্র অর্জন করেছে। যাই হোক বলতে গেলে কোন রকম রাস্তা না হারিয়েই আমরা পৌঁছুলাম মাখন কাকার বাড়িতে।

আমার দেখা সেই বাড়ির সাথে এর মিল নেই মোটেই। আমি ভেবেছিলাম আমরা যেদিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকছি, তাতে সেই খালটা থাকবে বাড়ির পেছন দিকটায়। কিন্তু খালটাকে আমি পেলাম অনেকটা সামনের দিকে, বাড়ির এক কোনায়। রতন চলে গেল ছানা-হারুর খোঁজে, আর আমি ঐ কুমে যেখানে এখনও একের পর এক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল অসংখ্য ভ্যাসাল। দেবদারু গাছের চিহ্ন পর্যন্ত দেখা গেল না কোথাও। ছিল না সেই হিজল গাছগুলোও। খালের ওপারে কিছুটা দূরে দেখা গেল কেরানীনগরের বাজার। মনে হোল বাজারটা যেন অনেক কাছে চলে এসেছে। পরে মনে পড়লো বাঙ্গালার কথা। বাঙ্গালা গিয়েও মনে হয়েছিল বাজারটা শশী জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ির কাছে চলে এসেছে। রাশিয়ায় একটা ছবির নাম “যখন গাছগুলো বড় ছিল”, আমায় মনে হয় সেই একই ফেনোমেনায় পেয়েছে, যখন বাজারগুলো দূরে ছিল।

হারু বাড়ি ছিল না, ছিল ছানা। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি করে, বসে সিংজুরী বাজারে। দুপুরে বাড়ি এসেছিল খেতে, বেরুবার আয়োজন করছিলো, আমাদের দেখে খুশী হোল। এলো চা বিস্কুট, বললো ওদের এখনকার জীবনের কথা, ছেলেমেয়েদের কথা। অনেক বদলে গেছে ছানা, জীবন মনে হয়না খুব সদয় ছিল ওদের প্রতি। দুই ছেলে – একজন সিঙ্গাপুর পাড়ি জমিয়েছে ভাগ্যের সন্ধানে, অন্যজন কৃষি বিজ্ঞানে পড়াশুনা  শেষ করে চাকরি খুঁজছে। বাড়িটা আগের মত নেই, আগের জায়গায়ও নেই। নদীর ভাঙ্গনে একটু সরিয়ে আনতে হয়েছে। এমনকি বাড়ির একটা অংশ বিক্রি করতে হয়েছে। না না, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষকে আশ্রয় দেয়া তো আর মুক্তিযুদ্ধ নয়! ওদের দেখে মনে হোল ওরা ভাল নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই ভাল থাকে না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ভাল থাকতে নেই।

সোভিয়েত ইউনিয়নে বা বর্তমান রাশিয়ায় যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে ফ্রন্টের সাথে সাথে আর যে শব্দটা উচ্চারিত হয় সেটা হোল রেয়ার বা পশ্চাদ্ভাগ যা কিনা যারা যুদ্ধের ফ্রন্টে আছে তাদের সরবরাহই নিশ্চিত করে না, যারা যুদ্ধে যায় নি বা যেতে পারেনি, তাদের নিরাপদ থাকার দায়িত্ব নেয়। তাই রাশিয়ায় যেমন যুদ্ধের ভেটেরান আছে, তেমনি আছে পশ্চাদ্ভাগের ভেটেরান। তবে সেটা রুশ দেশে, আমাদের দেশে নয়। আর তাইতো বিজয়ের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও কে যে মুক্তিযোদ্ধা আর কে যে নয় – তার সুরাহা আজও হয় না। 

২০১৩ সালে এল ব্রুস পাহাড়ে যাবো বলে গেলাম পিতিগোরস্ক বলে এক শহরে। এখানে বিখ্যাত রুশ কবি মিখাইল লেরমন্তভের “আমাদের সময়ের বীরেরা”র কিছু কালজয়ী ঘটনা ঘটে। সেখানে আমরা যখন একটা এক্সারশনে গেলাম, আমাদের নিয়ে যাওয়া হোল অনির্বাণ শিখার কাছে। এটা শুধু রুশ দেশে নয় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সব শহরেই ছিল। পাশেই বিশাল দেয়াল আর সেই দেয়ালের গায়ে খোদাই করা এই শহরের সেই সব মানুষের নাম যারা পিতৃভূমির যুদ্ধে প্রান দিয়েছিল। এটাকেই মনে হয় বলে জনগনের ইতিহাস। ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকে শুধু রাজা-মহারাজাদের কথা। আর এসব দেয়ালে থাকে সবার নাম। আর এভাবেই দেশ স্মরন করে তার বীরদের, শ্রদ্ধা জানায় শাধারন মানুষের আত্মত্যাগকে। তখন আমার মনে পড়লো, এই যে আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা বলি, শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের সুত্রপাত করি, আমরা কেন এই শহীদদের নাম খুঁজে বের করি না। আমরা কেন আমাদের গ্রামেগঞ্জে এরকম দেয়াল করে তার গায়ে যুদ্ধের সময়ে যারা মারা গিয়েছে, তাদের নাম লিখি না? এখনও অনেক সাক্ষী পাওয়া যাবে, কিন্তু আজ থেকে দশ, পনের, কুঁড়ি বা পঁচিশ বছর পরে ওই নামগুলো মনে করার বা উচ্চারন করার মত কেউ কি আর থাকবে? আমার মনে হয় যদি আমাদের গ্রামে যুদ্ধের সময় যাদের হত্যা করা হয়েছিল কোন একটা মেমোরিয়াল বা দেয়াল তৈরি করে সেখানে সেই ছয় জনের নাম খোদাই করা হোত, এতে শুধু তাদের স্মৃতির প্রতিই সম্মান জানান হোত না, যুদ্ধের বীভৎসতা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে হুশিয়ার করে দেয়া যেত, পাক হানাদার বাহিনী, তাদের দেশীয় দোসর আর বর্তমান প্রজন্মের নব্য রাজাকারদের সম্পর্কে অনবরত দেশবাসীকে সাবধান করা যেতো। এটা আজ শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুরন নয়, এটা সময়ের দাবী। 

বৈলতলা থেকে ফেরার পথে ইচ্ছে ছিল কালু বেপারীর সাথে দেখা করা, তবে উনি বাড়ি না থাকায় সেটা আর হয়ে উঠলো না। আজিজ ভাইকে নিয়ে কথা হোল। ছানাই বললো। উনি এখন স্থানীয় চেয়ারম্যান। হঠাৎ করেই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। মোটর সাইকেলে করে ফিরছিলেন। চিনলেন, বাসায় যেতে বললেন। সময়ের অভাবে সেটা করা হোল না। আমার মনে পরে গেল আজিজ ভাইয়ের সাথে শেষ দেখার কথা। একদিন সকালে অনেকে ধরাধরি করে ওনাকে নিয়ে এল আমাদের বাড়িতে। জমি নিয়ে কি এক বিবাদে ওনাকে আক্রমন করে প্রতিপক্ষ। ট্যাটা এসে বিঁধেছে তার পায়ে। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বয়েসের ছাপ যে খুব একটা লেগেছে তা মনে হোল না।  

হাঁটছি আমরা সিংজুরী বাজার দিয়ে, গন্তব্য অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। হঠাৎ এক লোক ছানাকে জিজ্ঞেস করলো
-   মেহমানরা তরা থেকে না?
-   হ্যা। বৃন্দাবন সাহার ছেলে এরা।
-   আমিও তাই ভাবছিলাম। বৃন্দাবন বাবুর ছেলে। চলেন, চা খেয়ে যান।
-   আমরা এই মাত্র চা খেয়ে এসেছি। এখন আর খাবো না।
-   এই দেখছেন, এটা আমার স’মিল। আরও একটা আছে। এই সবই নয়া কাকার আশীর্বাদে। খুব ভাল মানুষ ছিলেন। অনেক সময় টাকা-পয়সা থাকতো না। কাকা বলতেন, “অসুবিধা নেই। সুতা নিয়ে যাও। পরে টাকা দিও।“ শুধু আমাকে কেন, আমাদের এখানে তিন শ ঘর জোলা ছিল, সবাই তার কাছে ঋণী। এখনও সবাই তার কথা স্মরন করে। যদি কখনো কোন অসুবিধা হয়, জানাবেন। আমরা পাশে দাঁড়াবো।
এরপর অন্য মিল থেকে ছেলেকে ডাকলো। ছেলে এলে বললো
-   এই দ্যাখ, বৃন্দাবন বাবুর ছেলে এরা। এই যে মিলগুলো, এসবের জন্যে আমরা এর বাবার কাছে ঋণী।
তারপর আমাদের দিকে ঘুরে বললো
-   আবার আসবেন। বেশী সময় নিয়ে আসবেন। আপনাদের দেখলে এখানে অনেকেই খুব খুশী হবে।
আমরা ওনার আর ছানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটোরিক্সায় উঠে বসলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো একাত্তরের দিনগুলি। তখনও এই লোকগুলোই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো, আমাদের নিরাপদে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিল। আজ এরা আমাদের পাইকার নয়, আমাদের সে ব্যবসা-বানিজ্য নেই। তবে বাবার প্রতি এদের ভালোবাসা এখনও অটুট, এখনও আমাদের বিপদ-আপদে এরা আমাদের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। এটাই মনে হয় একাত্তরের চেতনা, এখানেই মনে হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের কবর, ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গান।

মস্কো, ১২ মার্চ ২০১৭     


No comments:

Post a Comment